ঢাকা, ২৯ এপ্রিল সোমবার, ২০২৪ || ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১৫৪

জিআই স্বত্ব-কৃতিত্ব ছিনতাই ও লুণ্ঠনের মহোৎসব

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৫:৩৪ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

বিশ্বব্যাপী চারিদিকে যেন জিআই স্বত্ব-কৃতিত্ব ছিনতাই ও লুণ্ঠনের মহোৎসব চলছে। ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই থেকে শুরু করে গ্রন্থ-গানের স্বত্ব, এমনকি কারো কারো ব্যক্তিগত কৃতিত্বও এর কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ভৌগলিকভাবে একটি নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিও নিস্তার পাচ্ছে না। 

 

আবার অন্যের লেখা বই বা বইয়ের অংশবিশেষ, প্রবন্ধ চুরি করে তা ছাপিয়ে নিজের বলেও চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি চৌর্যবৃত্তির মাধমে গবেষণার অভিসন্দর্ভ দিয়ে অনেকে পিএইচডি সনদ গ্রহণপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাও করছেন বলে মাঝে-মধ্যেই খবর পাওয়া যায়।  

 

জিআই হচ্ছে কোনো একটি পণ্যের জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা ভৌগলিক নির্দেশক। কোনো পণ্যের একটি নির্দিষ্ট উৎপত্তিস্থল দিয়ে এর খ্যাতি ও গুণাবলী নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। জিআই চিহ্নিত করতে উৎপত্তিস্থলের যেমন-শহর, অঞ্চল বা দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বৈশ্বিকভাবে এই জিআই বা পণ্যের স্বত্ব অনুমোদন দেয় ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও)।

 

আমাদের দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য ( নিবন্ধন ও সুরক্ষা ) আইন পাস হয় ২০১৩ সালে। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে আসছে ডিজাইন, পেটেন্ট ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর ( ডিপিডিটি )। ডব্লিউআইপিও-র নিয়ম মেনে পণ্যের স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে সরকারের এ বিভাগ।

 

আবার বিশ্বব্যাপী বই-পুস্তক-গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে আইএসবিএন এবং জার্নাল-ম্যাগাজিন প্রকাশের ক্ষেত্রে আইএসএসএন-এর মাধ্যমে লেখক, প্রকাশকদের স্বত্বের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হলেও সেটিও মাঝে-মধ্যেই ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যায়। 

 

সম্প্রতি ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’-র জিআই স্বত্ব নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। টাঙ্গাইল নামে কোনো অঞ্চল না থাকলেও সেই নামের শাড়ির জিআই স্বত্ব ভারত বাগিয়ে নিয়েছে। মাসখানেক আগে পণ্যটিকে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া ও পূর্ব বর্ধমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ টাঙ্গাইল যেমন ভারতের নয়, টাঙ্গাইলের শাড়িও তেমন ভারতের নয়। এর আগে নকশী কাঁথা, ঢাকাই জামদানিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের জিআই স্বত্ব ভারত লুণ্ঠন করেছিল। 

 

ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই স্বত্ব নিয়ে এমনতর ছিনতাই-লুণ্ঠন যে এটিই প্রথম, তা কিন্তু নয়। এর আগেও ফজলী আম, রেশম (সিল্ক), তিলের খাজা, রসগোল্লা, কবিতা, গান, ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এই অপকর্মটি ঘটেছে। যুগ যুগ ধরে ছিনতাই-লুণ্ঠন-চোর্যবৃত্তির ঘটনা ঘটেই চলেছে। 

 

অতি সম্প্রতি আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের বিখ্যাত সেই গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’-র সুর বিকৃত করা নিয়ে কী তুলকালাম কাণ্ডটাই না ঘটে গেল। বাংলাদেশের পটভূমিতে বলিউডে নির্মিত হিন্দী ছবি ‘পিপ্পা’-য় ব্যবহারের জন্য এ আর রহমামের মতো অস্কারজয়ী ভারতের প্রখ্যাত সুরকার ও পরিচালক গানটি রিমেক করতে গিয়ে বিকৃতভাবে তাতে নিজের সুর বসিয়ে অমার্জনীয় আপরাধ করে বসলেন।  

 

আবার কিছুদিন পূর্বে কলকাতার বিখ্যাত ‘রসগোল্লা’-র জিআই স্বত্ব ভারতের উড়িষ্যা রাজ্য কর্তৃক ছিনতাই হয়েছিল। পরে আপত্তির মুখে তা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ‘রসগোল্লা’ নামেই জিআই স্বত্ব লাভ করে। 
বুদ্ধিবৃত্তিতে চৌর্যবৃত্তির কথা প্রায়শই শোনা যায়। এক সময়ের জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ ‘মাসুদ রানা’ ও কিশোর রোমাঞ্চকর সিরিজ ‘কুয়াশা’-র লেখক হিসেবে আমরা কাজী আনোয়ার হোসেনকেই জানতাম। কিন্তু বছর দশেক আগে সিরিজগুলির প্রকৃত লেখক শেখ আব্দুল হাকিম বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে দায়েরকৃত এক অভিযোগে এই মর্মে দাবী করেছিলেন যে, ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের লেখক তিনি। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। 

 

প্রসঙ্গক্রমে, একটি বাস্তব গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। এক রাজ্যে এক মহাপরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। তিনি আবার পাঁড় (তথাকথিত) কবিও ছিলেন। প্রতি সপ্তাহেই তিনি বিখ্যাত বিখ্যাত কবিতা লিখতেন; যা তখনকার সময়ের পত্র-পত্রিকায় স্বগর্বে প্রকাশিত হতো। তার কিছু সভা (ভাঁড়) কবিও ছিলেন। ফি বছর পাঁড় ও ভাঁড় কবিরা মিলে কবিতা উৎসবও উদযাপন করতেন। এক সময় রাজার পতন হয়। তখন সভা কবিরা একে একে বলতে থাকেন রাজার লেখা কবিতাগুলোর লেখক আসলে তারাই। কি সেলুকাস ! চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমেও কবি হওয়া যায়।
আর অন্যের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের ঘটনা তো সমাজে অহরহ ঘটতেই আছে। সে কথা আর নাই বা বললাম। 

 

তাহলে এই যে জিআই বা পণ্যের স্বত্ব লুণ্ঠন-ছিনতাই বা অন্যান্য ক্ষেত্রে চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ঘটেই চলেছে; এটা রোধ করবে কে ? এভাবে ঢাকাই জামদানি, টাঙ্গাইল শাড়িসহ একের পর এক আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি লুন্ঠিত-ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে আমাদের বোধোদয় আর কবে ঘটবে ? আমাদের ডিজাইন, পেটেন্ট ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর ( ডিপিডিটি )-ই বা করছে কি ? বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডেরই বা দায়িত্ব কি?

 

লেখক: আবুল বাশার বাদল

সাংবাদিক ও গবেষক