ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৬০৭

নাক থেকে নমুনা সংগ্রহ কি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:৪৪ ১৯ জুলাই ২০২০  

করোনাভাইরাস পরীক্ষা মানুষের শরীরের ক্ষতি করে বিভিন্ন ভাষায় এমন দাবি ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করা কয়েকটি দাবি যাচাই বাছাই করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বিবিসির রিয়ালিটি চেক বিভাগের জ্যাক গুডম্যান ও ফিয়োনা কারমাইকেল। লাইফটিভি টুয়েন্টিফোর পাঠকদের জন্য বিশদভাবে তা তুলে ধরা হলো। 

নাক থেকে নমুনা সংগ্রহে মস্তিষ্কের ক্ষতি করে?

নাকের ভেতর থেকে সোয়াব বা নমুনা নেয়ার একটি ছবি ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে। তাতে দাবি করা হয়েছে নমুনা নেয়া হচ্ছে ‘ব্লাড-ব্রেন-ব্যারিয়ার’ থেকে। রক্ত থেকে কোনোরকম বিষাক্ত পদার্থ বা জীবাণু যাতে মস্তিষ্কে ঢুকতে না পারে, সেই কাজ করে এ ব্লাড-ব্রেন-ব্যারিয়ার। অর্থাৎ এটি মস্তিষ্কের জন্য একটি সুরক্ষা দেয়াল। নাকের ভেতর থেকে নমুনা নেয়ার সময় ওই দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব।

কেন সেটা অসম্ভব?

মস্তিষ্ককে রক্ষা করার জন্য তাকে ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্তর। প্রথম ও সবচেয়ে পরিচিত সুরক্ষা স্তর হলো মাথার খুলি। এ খুলির ভেতরেও মগজ বা মস্তিষ্ককে রক্ষা করছে সুরক্ষা ঝিল্লি এবং কিছু জলীয় পদার্থের আস্তরণ। মস্তিষ্কের দেয়ালে যে রক্তনালীগুলো আছে, সেটার মধ্যে থাকা ব্লাড-ব্রেন-ব্যারিয়ার হলো শক্তভাবে ঠাসা কোষের স্তর। এ সুরক্ষা স্তরের কাজ হলো রক্ত থেকে ক্ষুদ্র অণুকে মস্তিষ্কে ঢুকতে বাধা দেয়া। কিন্তু রক্ত থেকে অক্সিজেন এবং পুষ্টি এ স্তর ভেদ করে মস্তিষ্কে ঢুকতে পারে।

কাজেই বুঝতেই পারছেন, নাকের ভেতর দিয়ে সোয়াব নেয়ার জন্য কাঠি ভেতরে ঢোকানো হলে, মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে প্রথমে অনেকগুলো কোষের স্তর ভেদ করতে হবে। এর পর খুলির হাড়ের মধ্যে দিয়ে ঢুকতে হবে মস্তিষ্কের দেয়ালে রক্তনালীর ভেতর। সেখানে পাহারা দিচ্ছে ব্লাড-ব্রেন-ব্যারিয়ার। তাকে ডিঙিয়ে তবেই মস্তিষ্ককে জখম করার জায়গায় পৌঁছতে পারবে সোয়াব স্টিক!

সোশাল মিডিয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছে করোনা পরীক্ষার জন্য নাকের ভেতর থেকে নমুনা নেয়া হচ্ছে মস্তিষ্কের ব্লাড-ব্রেন-ব্যারিয়ার নামের সুরক্ষা আস্তরণ থেকে। বিবিসি বলছে এটা 'ভুল'। ব্রিটিশ নিউরোসায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের ড. লিজ কোলথার্ড বলেন, নাক থেকে নমুনা নেয়ার পদ্ধতিতে যে সোয়াব স্টিক ঢোকানো হয় তা 'ব্লাড ব্রেন ব্যারিয়ার' বা রক্তনালীর সুরক্ষা দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছতে হলে যথেষ্ট জোরে সেটা ঢোকাতে হবে। এতটা জোরে যাতে কয়েক স্তর কোষ, কলা ও হাড় ভেঙে সেটা ঢুকতে পারে। কোভিড সোয়াব নেয়ার সময় এ ধরনের কোনো জটিলতার ঘটনা আমরা দেখিনি।

নাক ও শ্বাসনালীর ভেতর থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় শ্বাসনালীর মধ্যে জীবাণুর উপস্থিতি পরীক্ষা করে দেখা হয়। ব্রিটেনে নাক ও গলা থেকে নমুনা নিয়ে নিয়মিতভাবে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা করা হচ্ছে। লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিকাল মেডিসিনের ড. টম উইংফিল্ড বলছেন, আমি হাসপাতালে বহু রোগীর নমুনা নিয়েছি। আমি একটা ট্রায়ালে অংশ নিচ্ছি। ফলে নিজের নমুনাও আমি প্রতি সপ্তাহে এভাবে নিচ্ছি। নাকের ভেতর দিয়ে সোয়াব নেয়ার সময় মাথার অত কাছে পৌঁছানো অস্বাভাবিক। এভাবে নমুনা নেয়ার সময় আপনার সুড়সুড়ি লাগার মতো বা চুলকানির মতো অনুভূতি হতে পারে। কিন্তু ব্যথা কখনই লাগবে না।

এ ভুয়া তথ্য ছড়াতে শুরু করে ৬ জুলাই আমেরিকার কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এবং কোনো কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে এ তথ্যের সঙ্গে টেস্টিং প্রত্যাখান করারও আহ্বান জানানো হয়। এমনকি ফেসবুকের নিজস্ব তথ্য যাচাই সংস্থাগুলোও এ ধরনের কিছু দাবি "ভুয়া" বলে জানিয়েছে। বিবিসি অনুসন্ধানে রুমানিয়ান, ডাচ, ফরাসি, পর্তুগিজ ভাষায় এ পোস্টে হাজার হাজার এনগেজমেন্টের নজির দেখেছে।

করোনা পরীক্ষা সামগ্রী থেকে সংক্রমিত হবেন না

করোনাভাইরাস পরীক্ষার সরঞ্জাম থেকে সংক্রমণ ঘটতে পারে- এমন ধারণা দিয়ে তথ্য ছড়ানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। মহামারি শুরুর দিকে আমেরিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসির ল্যাবে পরীক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা নেয়া হচ্ছে না এমন একটি খবর। কিন্তু সেটার অর্থ এ নয়, করোনা পরীক্ষা থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে।

ফেসবুকের একটি পোস্ট ছিল এরকম- আপনি কোভিড-১৯ চান- এভাবেই তা পেতে পারেন! এর সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত সংক্রমিত টেস্টিং কিটের খবর। বিবিসি এ দাবিকে "বিভ্রান্তিমূলক" লেবেল দিয়েছে। উপরের পোস্টটি দেয়া হয়েছিল ফক্স নিউজের উপস্থাপক টাকার কার্লসনের ফেসবুক ফ্যান পেজে। সেখান থেকে এটি ৩০০০ বারের বেশি শেয়ার হয়।

ওয়াশিংটন পোস্টের খবরটি ওই পোস্টে জুড়ে দেয়া হয়, সেটি প্রকাশিত হয়েছিল জুন মাসে। পুরো খবরটিতে তুলে ধরা হয়েছিল করোনা পরীক্ষা নিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে চালানো সমীক্ষার ফলাফলে বেরিয়ে আসা কিছু ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা এবং বিভিন্ন ল্যাবে যথেষ্ট সতর্কতা না নেয়ার খবর। এসব সমস্যাই সিডিসির টেস্টিং কর্মসূচি চালু করতে দেরি হওয়ার কারণ। সেটাই ছিল এ খবরের মূল বিষয়। এ খবরে কোথাও বলা হয়নি ত্রুটিপূর্ণ কিটের কারণে কোনো রোগী করোনা সংক্রমিত হয়েছে।

কিন্তু ফেসবুকের পোস্টে সংবাদপত্রের নিবন্ধটির ছবি এমনভাবে তোলা হয়েছিল, যেখানে শুধু শিরোনামই দেখা গেছে। আসল খবর সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব হয়নি। ফলে পাঠকরা ওই শিরোনামে বিভ্রান্ত হয়। ভারত ও আমেরিকার তথ্য যাচাই সংস্থাগুলো সোশাল মিডিয়ায় ছড়ানো এমন তথ্যও ভুয়া বলে প্রমাণ করেছে। দাবি করা হয়েছে, করোনা টেস্টিং রোগীর শরীরে গোপনে মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য গেইটস ফাউন্ডেশনের একটা চক্রান্ত।

ফেসবুকে এ চক্রান্তের তথ্য কয়েক হাজার বার শেয়ার হয়েছে। এর আগে একই ধরনের আরেকটি চক্রান্তের খবর ছড়িয়েছিল। তাতে সম্ভাব্য ভ্যাকসিন গবেষণার নামে মানুষের শরীরে মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দেয়ার ভয়ঙ্কর পরীক্ষার কথা ছড়ানো হয়েছিল। বিবিসি সেসময় ওই তথ্য ভুয়া বলে প্রমাণ করে।

বিল গেইটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডার সংস্থা গেইটস ফাউন্ডেশন এ দাবি নাকচ করে একটি বিবৃতিও দিয়েছিল। করোনা মহামারি বা এর টিকা আবিষ্কারের গবেষণার সঙ্গে কোনো ধরনের মাইক্রোচিপ বসানোর গোপন কর্মসূচির সংশ্লিষ্টতার কোনোরকম তথ্যপ্রমাণও কখনও পাওয়া যায়নি।

সোয়াব নেয়ার সময় শ্বাস কেন দেয়া যায় না?

একটি মিম ছড়িয়েছে এ প্রশ্ন তুলে- কোভিড ১৯ যদি সত্যিই নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়, তাহলে সোয়াব বা নমুনা নেয়ার কাঠির ওপর শুধু শ্বাস দিতে পারি না কেন? কেন স্বাস্থ্যকর্মীকে ওই কাঠি আমার নাকের ভেতর পর্যন্ত ঢোকাতে হবে? এ মিম এখন পর্যন্ত ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে শেয়ার হয়েছে অন্তত ৭ হাজার বার।

এ প্রশ্ন তুলে ছড়ানো দুটি মিমকে বিবিসি 'বিভ্রান্তিকর' লেবেল দিয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে জানি, করোনা ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দিলে। আক্রান্ত মানুষের হাঁচি বা কাশির সঙ্গে বাতাসের মধ্যে বেরিয়ে আসা ক্ষুদ্র শ্লেষ্মাকণা ভাইরাসে ভরা থাকে। নমুনা নেয়া হচ্ছে কাঠির মাধ্যমে। আপনি সেটার ওপর শুধু শ্বাস ফেললে। তাতে ল্যাবে পরীক্ষা করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ শ্লেষ্মাকণা সংগ্রহ করা যাবে না।

বিবিসি ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে। তারা বলছেন, নাক বা গলার ভেতর থেকে সরাসরি শ্লেষ্মা সংগ্রহ করলে তবেই এ ভাইরাসের উপস্থিতি সম্পর্কে সঠিক পরীক্ষা করা সম্ভব। নমুনা নেয়া হয় সোয়াব স্টিকের মাধ্যমে। সেটার মাথার অংশটা খুবই সরু। এর ওপর আপনি নিঃশ্বাস ফেললে আপনার নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বেরিয়ে আসা ভাইরাস কণা কাঠির ওইটুকু অংশ দিয়ে সংগ্রহ করা সম্ভব নাও হতে পারে।

কাঠিটি নাক বা গলার মধ্যে ঢুকিয়ে যেহেতু সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নমুনা নেয়া হয়, তাই সংক্রমণ হয়ে থাকলে কাঠির আগায় যথেষ্ট জীবাণু ধরা পড়ে। একমাত্র এভাবেই সংক্রমণ সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব।

করোনাভাইরাস বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর