ঢাকা, ২৭ অক্টোবর সোমবার, ২০২৫ || ১২ কার্তিক ১৪৩২
good-food

স্বর্ণ কেনা-বেচার সময় কি এখনই?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৭:৩৪ ২৭ অক্টোবর ২০২৫  

‘কম দামে কিনে, বেশি দামে বিক্রি’—বিনিয়োগের এই মূলমন্ত্রটি স্বর্ণের বর্তমান পরিস্থিতিতে এক জটিল ধাঁধার সৃষ্টি করেছে। এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় দরপতনের সাক্ষী হলো স্বর্ণের বাজার। একদিনে ৫ শতাংশের বেশি দাম কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। দাম কমেছে সত্যি, কিন্তু তা কি কেনার জন্য যথেষ্ট কম?

 

এই বড় পতনের পরেও বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৪,১০০ ডলারের উপরে অবস্থান করছে, যা ঐতিহাসিক দিক থেকে এখনও অনেক উচ্চমূল্য। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন—এখন কি স্বর্ণে বিনিয়োগের সঠিক সময়? নাকি মুনাফা তুলে নিয়ে সরে দাঁড়ানোর পালা?মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফোর্বসের প্রতিবেদন অনুসারে, স্বর্ণে যারা নতুন করে বিনিয়োগ করতে চান বা যারা এরইমধ্যে বিনিয়োগ করে রেখেছেন, তাদের জন্য কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করা জরুরি।

 

স্বর্ণের উত্থান আর পতনের ইতিহাস

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, স্বর্ণের বড় উত্থানের পর এসেছে দীর্ঘস্থায়ী পতন। কোনো সম্পদের দামই চিরকাল বাড়তে থাকে না, আর স্বর্ণও তার ব্যতিক্রম নয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে স্বর্ণে এক বিশাল ‘বাবল’ তৈরি হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ৬৭৩.৬০ ডলার, কিন্তু ১৯৯৮ সালের আগস্টে তা নেমে আসে ২৫৬.১০ ডলারে—অর্থাৎ প্রায় ৬২ শতাংশ পতন। এরপর সেই ১৯৭৯ সালের শীর্ষ দামে ফেরত যেতে সময় লেগেছিল ২৬ বছর, ২০০৬ সালের মে মাস পর্যন্ত।

 

আরেকটি বড় পতন শুরু হয় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন স্বর্ণের দাম ছিল ১,৭৭১.৯০ ডলার। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তা নেমে আসে ১,০৬৮.৩০ ডলারে—প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়। এরপর সেই দামের পুনরুদ্ধার হয় ২০২০ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ প্রায় ৯ বছর পর।

 

এদিকে ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্বর্ণের গড় বার্ষিক রিটার্ন ছিল ৬.০৩ শতাংশ। একই সময়ে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের গড় বার্ষিক রিটার্ন ছিল ১০.৭৯ শতাংশ। ফলে ১০,০০০ ডলার বিনিয়োগ করলে স্বর্ণে তা বেড়ে দাঁড়াতো প্রায় ৯৫,০০০ ডলারে, কিন্তু শেয়ারবাজারে একই অর্থের বিনিয়োগে তা ছাড়িয়ে যেত ৪,০০,০০০ ডলারেরও বেশি। তবে ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে শেয়ারবাজারের রিটার্ন গড়ের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, যা ভবিষ্যতে হয়তো পুনরাবৃত্তি নাও হতে পারে।

 

কে কিনছে স্বর্ণ?

এতকিছুর পরেও স্বর্ণের দাম কেন এতটা শক্তিশালী! উত্তর লুকিয়ে আছে এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যে। ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার মূল চালিকা শক্তি । ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী স্বর্ণ কিনছে ইটিএফ, মিউচুয়াল ফান্ড, ও শারীরিক স্বর্ণ (যেমন কয়েন) আকারে। এই গোষ্ঠী সাধারণত বিনিয়োগের শেষ পর্যায়ে বাজারে প্রবেশ করে—যখন দাম অনেক বেড়ে যায় এবং গণমাধ্যমে প্রচার বাড়ে। তখনই তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়, কিন্তু অনেক সময় তখন বাবল ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়।

 

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী—যাদের ‘স্মার্ট মানি’ বলা হয়—তারা সাধারণত আগে থেকেই সুযোগ শনাক্ত করে। বর্তমানে স্বর্ণভিত্তিক ফান্ডে বিনিয়োগ গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও এখন বড় ক্রেতা। অতীতে চীন স্বর্ণ বিক্রি করত, কিন্তু ২০২৪ সালে চীন, পোল্যান্ডসহ অনেক দেশ ব্যাপকভাবে স্বর্ণ কিনেছে।শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদাও বাড়ছে। স্বর্ণ বিদ্যুতের ভালো পরিবাহী এবং সহজে মরিচা ধরে না। তাই এটি ব্যবহৃত হচ্ছে সার্কিট বোর্ড, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, সেমিকন্ডাক্টর চিপ, এমনকি মহাকাশ, স্বাস্থ্যসেবা ও অটোমোটিভ খাতেও।

 

স্বর্ণের চাহিদার আরেক উৎস হচ্ছে ভয়

আমরা জানি চাহিদা যখন সরবরাহের চেয়ে বেশি হয়, তখন স্বর্ণের দাম বাড়ে। বর্তমানে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান—সবাই স্বর্ণ কিনছে। এর একটি বড় কারণ হলো ভয়। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, বাণিজ্য উত্তেজনা ও শুল্কসংক্রান্ত অস্থিরতার কারণে মানুষ ও সরকার উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, তাই তারা এসব ধাক্কা সামাল দিতে পারে। কিন্তু ছোট দেশগুলোর অর্থনীতি নাজুক, তাই শুল্কবৃদ্ধি তাদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

 

তবু মনে রাখতে হবে—স্বর্ণ যতই বাড়ুক, একসময় তা চূড়ায় পৌঁছে আবার কমবে। বাবল যত বড় হয়, পতনও তত গভীর হয়। আজকের দামপতন যদি মুনাফা তুলে নেওয়ার কারণে হয়ে থাকে—যা বড় উত্থানের পর স্বাভাবিক বিষয়—তাহলে এখনই স্বর্ণের উত্থান শেষ হয়নি... অন্তত এখনও নয়।

 

এখন কি কেনার সময় নাকি বিক্রির?

বিশেষজ্ঞরা আজকের এই ৫.৫ শতাংশ দরপতনকে একটি স্বাভাবিক ‘প্রাইস কারেকশন’ বা মুনাফা তুলে নেওয়ার ফল হিসেবে দেখছেন। একটি বড় উত্থানের পর এমন পতন অস্বাভাবিক নয়। যারা এখনও স্বর্ণে বিনিয়োগ করেননি, তাদের জন্য এই পতন একটি ভালো ‘এন্ট্রি পয়েন্ট’ বা বাজারে প্রবেশের সুযোগ হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, স্বর্ণের বাজার যতই শক্তিশালী হোক না কেন, কোনো কিছুই চিরকাল বাড়ে না। বাবল যখন তৈরি হয়, তা একসময় ফাটেও। আজকের দামপতন যদি শুধুমাত্র মুনাফা তুলে নেওয়ার কারণে হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায়—স্বর্ণের উত্থানের গল্প এখনই শেষ হয়নি... অন্তত এখনও নয়। বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত অবশ্যই নিজের ঝুঁকি সামলানোর ক্ষমতা এবং বাজারের গভীরতা বিচার করে নেওয়া উচিত।