ঢাকা, ২০ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪ || ৭ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১২২১

নারী কিংবা পুরুষ নয়, দরকার ‘মানুষ’ হবার শিক্ষা

নবনীতা চক্রবর্তী

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:০৭ ১৮ জানুয়ারি ২০২০  

চলমান বিশ্বে আমরা কেউই নারী পুরুষের সম্পর্কটি সহজভাবে নিতে পারি না।  সেই সাথে দুজন মানুষের সম্পর্ক কিরূপ হওয়া উচিত সেটি সম্পর্কে নেই পূর্ণাঙ্গ ধারণা।

 

সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে একটি মানুষের বেড়ে উঠবার ক্ষেত্রে।  কিন্তু নিদারুণ বাস্তবতা হল, শৈশব থেকেই নারীকে নারী হয়ে উঠবার ও পুরুষকে পুরুষ হয়ে উঠবার শিক্ষা দেয়া হয়।  লিঙ্গ নির্ধারনের ভিত্তিতে তাদের বেড়ে উঠবার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কাউকেই মানুষ হিসেবে বড় হবার শিক্ষা দেওয়ার কথা আমাদের মনে থাকে না। এটি যে সবসময় জেনে  বুঝেই করা হয় তা কিন্তু নয়। খুব অসচেতনভাবেই প্রভেদ সৃষ্টি হতে থাকে।  

 

যেমন আমরা ভেবেই নেই মেয়ে শিশু মানেই সে ধৈর্যশীল হবে,  শান্ত হবে, পুতুল খেলবে, তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে রাখা যাবে। গায়ের রঙ হবে টুকটুকে ফর্সা।

 

ছেলে শিশু মানেই চঞ্চল হবে দুস্টু হবে, ছুটে বেড়াবে চারিদিক। খেলনা হিসেবে সে পাবে গাড়ি, উড়োজাহাজ, বল ইত্যাদি। গায়ের রঙের ব্যাপারে নেই কোন কড়াকড়ি।  সোনার আংটি নাকি বাঁকা হলেও ভালো।  

 

রূপকথা গল্প থেকে শুরু করে আজকের জীবনের গল্পগুলো একই ছাঁচে গড়া। রাজকণ্যে দৈত্যপুরীতে বন্দি থাকবে।   অপেক্ষা করবে এক রাজপুত্তুরের জন্য, যে তাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। কল্পনার প্রথম ধাপেই একজন শিশু মনে করে নেবে রাজকণ্যে মানেই এক অবলা অসহায় মেয়ে।  যার কাজই শুধু কান্নাকাটি করা আর রাজপুত্তুরের জন্য অপেক্ষা করা।

 

আবার, নারীকে হতে হবে কুসুম কোমল, স্নিগ্ধ লাবণ্যে ঢল ঢল এবং পুরুষকে হতে হবে বীর, শক্তির আধার বিশেষ।

 

নারী গড়বে আর পুরুষ ভাঙবে - এই জাতীয়  অদ্ভুত সব ব্যাখ্যা রয়েছে এই সমাজে। যার আদৌ কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

 

যাহোক এই দুই ধরনের মানুষদের আমরা Arche type চরিত্র বানিয়ে রেখেছি।  Arche type শব্দের অর্থ হল কোন বিষয়ে আগে থেকেই ইমেজ তৈরী হয়ে থাকা।  

 

যেমন মা শব্দটি উচ্চারনের সাথে সাথে আমাদের মনে ভেসে ওঠে সংসারের যাঁতাকলে পিস্ট সন্তানের জন্য সর্বদা চিন্তাক্লিস্ট একটি মুখ। ছিমছাম লাবন্যময়ী সহজ সরল নারী। সাতেও নেই, পাঁচেও নেই । সাত চড়ে মুুুখে রা কাটবে না ।  অথচ সবসময় যে লাবন্যময়ী হতে হবে বা মুুখরা হতে পারবে না এমনটা তো নয়। তার যে দীঘল কেশরাজি না থেকে ববছাট চুলও থাকতে পারে, সেটাও যে মাতৃরুপ হতে পারে  সেটা কিন্তু আমাদের কল্পনাতে বড়ই দুর্লভ। মায়ের মাতৃত্বের রুপটি নয় তার অনুভবটি গুরুত্বপূর্ণ।

একই কথা বাবার ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য।

 

সম্প্রতি কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে  গ্রেফতারকৃত অপরাধী ধর্ষকটিকে নিয়ে নানা সন্দেহ, জল্পনা, কল্পনা চলছিল। কিছু মানুষের মন কোনভাবেই গ্রেফতারকৃত লোকটিকে প্রকৃত অপরাধী বলে মানতে নারাজ।  কারণ তার বাহ্যিক আচরন, শারীরিক অবয়ব, সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে মানুষের কাছে তা সন্দিহান হয়ে উঠেছে।

 

তারচেয়েও বড় বিষয় আমাদের মনে ও মস্তিষ্কে একটি ছবি সেঁটে গিয়েছে, আমাদের প্রচলিত ধারনা হয়ে গিয়েছে যে ধর্ষক একজন বীরপুরুষ গোছের কেউ হবে। বলশালী, প্রভাবশালী, তেজোদীপ্ত, বয়সে তরুন কেউ হবে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই বা আমাদের যুক্তি এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে যে প্রত্যেক ধর্ষনকারী একজন অপরাধী।  তাই তারা বীরপুরুষ তো দূরের কথা তারা হয় আস্ত কাপুরুষ।

 

নিজেদের সম্পর্কে তারা হীনমন্যতায় ভোগে সবসময়, তাছাড়া যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে।

 

গবেষণায় দেখা গিয়েছে শুধু যৌন লালসা বা কামুকতা পাশবিক ও যৌন অত্যাচারের কারণ নয়। জীবনের নানা পর্যায়ের হতাশা থেকে যে মানসিক বিকৃতি তাদের ঘটে, সেই প্রবৃত্তির দ্বারা তারা এই জঘন্য অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। তারা ভিকটিমের যন্ত্রণা,  অপমান, অসহায়ত্বকে উপভোগ করে।

 

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা খুব ছোটবেলায় কারো কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে বা অভিভাবকের শাসনের নামে অত্যাচারের শিকার হয়েছে  তারা এরকম অপরাধমনস্ক হয়ে ওঠে। ফলে দেখা যায় অজান্তেই একটি বিদ্বেষবোধ নিয়ে সে বেড়ে ওঠে। আর এর ফলে মানুষ সম্পর্কে তার ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয়। এই ধরনের মানুষ খুব সহজভাবে কোন কিছুই গ্রহণ করতে পারেনা।

 

 

অন্যদিকে এধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া, ক্ষেত্র বিশেষে বিচারহীনতা, শাস্তি কার্যকর না হওয়া,  ভিকটিমের  সুরক্ষার বিষয়ে উদাসীনতা অপরাধীকে অনেকটা সাহসী করে তোলে। আর এর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নারীদের ওপর।

 

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহতা হল শুধু প্রভাবের ওপর বিষয়টি আর আটকে নেই। নারীদের প্রতিনিয়ত বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে ।  সমাজ ও রাষ্ট্রেের প্রতি অনাস্থা বাড়ার সাথে সাথে সমাজ বিপন্ন হচ্ছে। সম্পর্কগুলো সুস্থতা হারিয়ে ফেলছে। নারী প্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

 

উল্লেখ্য যে ছেলে শিশুরাও এমন পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ভাবতেও গা শিয়রে ওঠে, জীবন সম্পর্কে   কী মারাত্মক ধারনা নিয়ে সে বড় হবে। তার কাছে ভালো কিছু আশা করাটাই হবে চরম বোকামি। ফলশ্রুতিতে আমরা সামগ্রিক একটি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি।

 

গভীরভাবে ভাবার সময় এখনই। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এই সমস্যা ও অপরাধ মোকাবেলায় জোট বাধতে হবে। পুলিশ, প্রশাসন,  আইন, বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়ন বিশেষ করে ধর্ষন সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো দ্রুত ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থাসহ সর্বস্তরে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষার ভিত হতে হবে মজবুত। কারণ একটি ঘটনার দায় সমাজে বসবাসরত মানুষ হিসেবে আমরা কেউই এড়াতে পারিনা। তাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে সবাইকে। প্রতিবাদের চেয়েও প্রতিরোধ জরুরি।

 

নারীরা পাশবিক অত্যাচার, সামাজিক ফতোয়া বা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারী বলে নয়, বরং তাকে নারী হিসেবে গণ্য করা হয় বলেই তারা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। সনাতনী ধ্যান ধারনার কারণে ভূমিষ্ঠ হবার আগেই তার ভাগ্য নির্নীত হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো অনুসারে। এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষরা তো বটেই নারীরাও বহন করে আসছে যুগের পর যুগ। তাই নারীদের তৈরী হতে হবে।


যেমন অধিকাংশ সময়ে কোন কিছু বিচার বিশ্লেষণ না করে নারীকেই দোষারোপ করা হয়। বলা হয়, তার চলাফেরায় ত্রুটি ছিলো,  পোশাক ঠিকঠাক ছিলো না ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো কোন কাজের কথাই নয়। এটিও নারীকে দুর্বল করে তোলার একটি কৌশল বিশেষ।  নারী বিদ্বেষের মাধ্যমে নারীর ও্পর জোর খাটানোর অপচেষ্টা মাত্র।

 

সমাজে নানান ক্ষেত্র আমরা তৈরী করে রেখেছি যা সময়ের সাথে সাথে নারী পুরুষের প্রভেদ এর ধরন বাড়তে শুরু করে।  নারী মানে ঘরসংসার আর পুরুষ মানেই  বাহির, বকির্জগত। পুরুষের ওপর দ্বায়িত্ব অর্পিত হয় তাকেই সবার ভরন পোষণের ভার নিতে হবে, যাবতীয় কর্তব্য পালন ও সুরক্ষার দায় একান্তভাবে তার। হাজার দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধ খুব সূক্ষ্মভাবে তাকেও কর্তৃত্ববাদী করে তোলে।

 

সেই সাথে যুক্ত রয়েছে   নানান প্রচলিত প্রথা। যার দোহাই দিয়ে যেন মৌন সমর্থন পেয়ে যায় শত অপরাধ করার।  আর এভাবেই প্রতিনিয়ত আমরা জন্ম দিয়ে চলেছি লিঙ্গবৈষম্যের। পারিবারিক শিক্ষা ও চিন্তা ধারণা মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে।  পরিবার থেকে যখন একটি শিশু পরবর্তীতে নারী বা পুরুষ এই দুই এর ধারণা দ্বারা তাড়িত হয় তখন সৃস্টি হয় নানা জটিলতার। তার দৃস্টিতে নারীর কোন সম্মান থাকে না। এই ধারণা  ক্রমাগত নারী পুরুষ উভয়ের মনেই প্রথিত হয় যা থেকে সরে আসা পরবর্তীতে খুব বেশি সম্ভব হয়না। 
 এই যে আমরা বৈষম্যের কথা বলছি সেটা কিন্তু সমাজের সৃস্টি।  সমাজ থেকেই নির্ধারিত হয় আমাদের আচার আচরণ কথা বার্তা  মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

 

সমাজে বসবাসরত প্রতিটি শ্রেণীর মানুষকে বুঝতে হবে নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাতিত সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যায় না। বিশেষ করে নারীদের একটি বিষয় খুব করে বুঝতে হবে যে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা আনে সঠিক আত্মবিশ্বাস, আনে মুক্তি। সর্বোপরি আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে একটি   বৈষম্যহীন সমাজ, রাষ্ট্র তথা পৃথিবী গড়ে তুলতে।  

 

#  নবনীতা চক্রবর্তী, এডুকেশন সেক্রেটারি, স্টেজ অব ইয়ুথ                                                                               

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর