ঢাকা, ২৯ এপ্রিল সোমবার, ২০২৪ || ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
২৫৯

পরীমণি এবং আমাদের মেধাশূন্যতার দায়

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:৫০ ২৬ অক্টোবর ২০২৩  

পুলিশ আমার বাসায় অভিযান চালালে পানিভর্তি দুইটা মদের বোতল পাবে। বসুন্ধরা শপিং মলের পাশের ফুটপাতে ঝুড়িতে বিক্রি করা এক হকারের কাছ থেকে কিনেছিলাম বোতল দুইটা। বিক্রেতা লোকটা শহরের এক পাঁচতারকামানের হোটেলে কাজ করেন। সেখানে মদ বিক্রি হয়। তবে কেউ যদি আমাকে ফাঁসানোর জন্য পুলিশে অভিযোগ করে এবং পুলিশ অভিযান চালায় তাহলে পাওয়া যাবে বিপুল পরিমান মদের বোতল, মাদকদ্রব্য এবং অস্ত্র। যেগুলো পাওয়া গেছে পরীমণি, মৌ, পিয়াসা কিংবা আর যাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। কপি পেস্ট আর কী! বন্দুক যুদ্ধের স্ক্রিপ্ট যেমন তৈরি থাকে, ঘটনার পর শুধু সংখ্যাটা বসিয়ে দেয়া হয়!

 

তবে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভবনা নাই। প্রতিদিন অনেক মর্মান্তিক এবং আশ্চর্যজনক ঘটনার সাথে আমার কাল্পনিক ঘটনা হাস্যকর। এখন পণ্য হিসেবে যে ঘটনাটির মূল্য বেশি সেটিই ডালপালা গজাচ্ছে। আর সংবাদপণ্যটি যদি ‘নারী’ হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। তখন করোনার ভয়াবহতা ম্লান হয়ে পড়ে। আইসিইউ’র জন্য লাইন দেয়া স্বজনরা আইসিইউ পাওয়া রোগীটির মৃত্যু কামনা করতে থাকে। এই নির্মম সত্যটি চাপা পড়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য প্রাণহানীর ঘটনা আলোচিত প্রধান সংবাদ হয়ে উঠতে পারেনা। নাম সর্বস্ব চটি গণমাধ্যমগুলো রগরগে গল্প সাজিয়ে নারীকে আচার বানিয়ে গরম গরম পরিবেশন করে। প্রথম শ্রেণির গণমাধ্যমগুলোও নিজেদের রেটিং বাড়ানোর জন্য একই পথে হাঁটে।

 

বর্তমান সময়ের আলোচিত সংবাদপণ্যটি হলো ঢাকায় চলচিত্রের আলোচিত নায়িকা পরীমণি। অফিস আদালত, পথঘাট, হাটবাজার, চায়ের আড্ডা…সবখানেই পরীমণি। পরীর নাম শুনে জীবনের শেষ সময়টুকু পার করতে থাকা বুড়োটিও রসের হাসি হাসে। ‘গ্রাম থেকে আসা গরীর ঘরের সন্তান,’ ‘রাতের রাণী,’ ‘চরিত্রহীন,’ নানান শব্দবন্ধে তার চরিত্র স্খলনের চেষ্টা। বিচার না হতেই রায় দিয়ে ফেলা। ঘটনার পেছনে ঘটনা থাকে। তার পেছনেও ঘটনা থাকে। আমাদের তড়পানিটা সামনের ঘটনা নিয়ে। পোস্টমর্ডানিজম এটাকে কোনভাবেই সমর্থন করেনা।

 

তাসলিমা বেগম রেনু কিংবা বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের ঘটনা এখনও আমাদের মগজে ক্ষত হয়ে আছে। মানুষ মানুষকে কুপিয়ে পিটিয়ে পুড়িয়ে মারছে! কিছু মানুষ দূর থেকে তামাশা দেখছে!... পরীমণির বাসায় অভিযানের দিনও এমন তামাশা দেখেছে মানুষ। সে সময় যে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সেটা কোনভাবেই কাম্য হতে পারেনা। বোর্ডক্লাব কান্ডের পর সমষ্টিগতভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন পরীমণি। আটকের পরও হয়েছেন। কাজী হায়াৎ পরিমণির পৃষ্টপোষকদের বেঁধে নিয়ে যেতে বলেছেন পুলিশকে। একমাত্র নির্দেশক চয়নিকা চৌধুরীকে পরীমণির পাশে এসে দাঁড়াতে দেখেছি। আর এই ‘অপরাধে’ তাঁকে জনসম্মুখে হেনস্তার শিকার হতেও দেখেছি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। তার কর্মকান্ডকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

 

অন্যদিকে একজন চলচিত্র শিল্পীর আস্থা আর নিরাপত্তার জায়গা ‘শিল্পী সমিতি’ এই বিপদে পাশেতো আসেইনি, উল্টো পরীমণির সদস্যপদ স্থগিত করে নিজেদের গা বাঁচিয়েছে। চলচিত্রাঙ্গনে পাতা থাকে নানান ফাঁদ। এখানে ভুল মানুষগুলোকে কিংবা এই ফাঁদকে অতিক্রম করতে না পেরে অনেকে জ্বলে উঠার আগেই নিভে গেছে। বিভিন্ন সময় চরিত্রহীন ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের লালসার বস্তু হতে হয়েছে চলচিত্র তারকাদের। এই ভুল মানুষগুলো নিজেদের অর্থ আর ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তারকাদের অভিভাবকদের দুর্বলতা কিংবা তাদের অভিভাবকহীনতাকে কাজে লাগায়। কাজ না হলেই সেই তারকার ক্যারিয়ার আর চরিত্র ধংস করে ফেলে। অথবা মেরে ফেলে। একসময়ের ঢাকায় চলচিত্রের আলোচিত নায়িকা অন্তরার কথা আমাদের স্মরণে আসবে। এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী প্রতারণা করে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল তাকে। একসময় মেরেও ফেলে। অন্তরার মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের নির্দেশে কবর থেকে তোলা হয় অন্তরার লাশ। সেই পর্যন্তই। আর কোন খবরে নেই অন্তরা।

 

ব্যবসায়ী নাসির গ্রেফতার হবার পর লন্ডনে লেখক কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে বাংলাদেশি এক ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী পরিমণিকে দেখে নেবার হুমকি দিয়েছিলেন। তার মাত্র ক’দিনের মাথায় পরিমণি আটক হলেন। এই সকল ব্যবসায়ীর অভিভাবকত্ব করেন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তা। এদের আসকারায় এসব ব্যবসায়ী ফিল্মের তরণীদের পণ্য বানায়। ব্যর্থ হলে ক্যারিয়ার আর চরিত্র ধংস করে। মেরে ফেলেও থাকে বহালতবিয়তে। মুম্বাই ফিল্মের এক নায়িকার কথাও আমরা জানি। এক ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী সেই নায়িকাকে লালসার শিকার করতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ কমিশনার বন্ধুর সহায়তা নিয়ে তাকে ফাঁসায়। ধংস করে দেয় তার শিল্পী জীবন। পরীমণির ঘটনাকে মুম্বাই ফিল্মের সেই ঘটনার পূণরাবৃত্তি বলেই মনে হয়।

 

পরিমণিতে প্রকৃতিগত সৌন্দর্যের যে সুষম বন্টন তা ঢাকায় ফিল্মের কেউ শিল্প সৃষ্টির কাজে লাগাতে পারেনি। তবে তার অভিনয় শৈলীকে কাজে নাগানোর চেষ্টা করেছেন ঢাকায় চলচিত্রের পরিচালক রাশিদ পলাশ। তার ঐতিহাসিক সিনেমা ‘প্রীতিলতা’র প্রকাশিত পোস্টার দেখে খানিকটা অনুমান করা যেতে পারে। শিল্পীর সৌন্দর্যকে শিল্প হয়ে উঠতে দেখি চিত্রশিল্পী, কবি, চলচিত্র নির্মাতা মকবুল ফিদা হুসেনের সিনেমায়। তিনি ছিলেন মাধুরী দীক্ষিতের ‘রূপমুগ্ধ’ শিল্পী। শারীরিক সৌন্দর্য যে শিল্প হয়ে উঠতে পারে সেটা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর ’গজগামিনী’ সিনেমায়। এই সিনেমায় মাধুরীর শারীরিক সৌন্দর্য শিল্প হয়ে ধরা দেয় দর্শকের চোখে। আমরা পরিমণির সৌন্দর্যকে শিল্প সৃষ্টির কাজে লাগাতে পারিনি। এই ব্যর্থতা এই মেধাশূন্যতার দায় আমাদেরই বহন করতে হবে। পরিমণিকে যদি বিপথগামী তকমা দিই, সেই বিপথগামীতার দায়ও এড়াতে পারিনা আমরা।

 

লেখক: মাজহারুল ইসলাম সজল

গণমাধ্যম কর্মী