ঢাকা, ১৯ মার্চ মঙ্গলবার, ২০২৪ || ৫ চৈত্র ১৪৩০
good-food
৬০৭

শিশুর প্রতি সহিংসতা কেন?

নবনীতা চক্রবর্তী

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৯:২৮ ১৬ অক্টোবর ২০১৯  

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ছাড়পত্র কবিতায় লেখেন,  
"আজ যতক্ষণ দেহে
আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব
জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য
ক'রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ়
অঙ্গীকার।"
কিন্তু আমরা সভ্য সমাজের মানুষেরা পৃথিবীর জঞ্জাল সরানোর চেয়ে শিশুদেরই জঞ্জাল মনে করে সরিয়ে দেওয়াটা সহজ মনে করছি। 
বিগত ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনায় দেখা যাচ্ছে শিশুরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ও প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে।  কারণ শিশুরা  যথোপযুক্ত মনোযোগের বিষয় নয়। শিশুরা আমাদের সমাজে এখনও খুব গুরুত্বপূর্ণ  মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি।  যদিও কায়মনোবাক্যে একটি বুলি আওড়ে যাই, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ।  এই ভবিষ্যত এতটাই অনিরাপদ এতটাই অরক্ষিত এতটাই মূল্যহীন যে, তাদের জীবন আমাদের কাছে ক্ষোভ প্রশমনের মহড়া বিশেষ। যাদের ইচ্ছে মতো শাসনের তকমা এঁটে  মারপিট করা যায়, অপমান অপদস্ত করা যায়, যখন ইচ্ছে তাদের প্রাণ নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়, কাউকে শিক্ষা দেওয়া যায়,  আবার ঘৃন্য যৌন লালসা মেটানো যায়। 
আবার শিশু হত্যাকারীদের একটি সুবিধা হল তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ বা নিন্দা জ্ঞাপনের মধ্যেই জনরোষ সীমিত থাকবে। এটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় কারো হবে না।  কারণ শিশুহত্যার সমাজে যতই মারাত্মক বা আত্মঘাতী প্রভাব থাকুক না কেন সেটি নিয়ে হালের রাজনীতিতে কোন পানি পাওয়া যাবেনা। ঘটনার নানান রুপ দেওয়া থেকে শুরু করে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করাও সম্ভব হবে না। খুব একটা ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক স্বার্থসিদ্ধি লাভ হবেনা। তাই খুব অনায়াসে কোন শিশুর পেটে বাতাস ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, হাতুড়ি দিয়ে পেটানো যায়, ছুরিকাঘাত করা যায়, স্পর্শকাতর স্থানকে রক্তাক্ত করা যায়, মুখ পুড়ানো যায়, পেটে ছুরিবিদ্ধ করে গাছের সাথে ঝু্লিয়ে রাখা যায়। এক কথায় নৃশসংতা, অপরাধের সমস্ত সীমা নির্বিকারে পার করা যায়। 
সমাজে নীতিবান মানুষদের অনেক আগেই মৃত্যু ঘটছে। যা আছে তা ফাঁকা বুলি মাত্র।  মানুষের যে মানসিক বিকৃতি ঘটছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ  নেই। কিন্তু এই বিকৃতির চরম মূল্য দিতে হচ্ছে শিশুদের। তাদের প্রতিনিয়তই শিকার হতে হচ্ছে চরম আক্রোশের। 
শিশুরা শুধু আক্রোশ বা প্রতিহিংসার শিকার নয় অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের না পারা স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার। জীবনের শুরুতেই এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ হবার নামে মগজ ধোলাই দেওয়া হয়, যেকোন মূল্যে  জীবনে তাকে জয় লাভ করতে হবে। ভালো ফলাফল, ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারা,  মোটা বেতনের কর্মসংস্থান ইত্যাদির মতো আপাত দৃশ্যমান চাকচিক্য হয়ে উঠছে মানুষ হওয়ার মাপকাঠি। যা অঙ্কুরেই বিনষ্ট ঘটাচ্ছে প্রকৃত মানুষ হওয়ার মূল্যবোধ। অতি সন্তর্পণে বোধ বিবেকহীন, মায়া মমতাহীন একটি প্রজন্ম তৈরী হচ্ছে।  যার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে একেকটি বিস্ফোরক ঘটনার মাধ্যমে। 
" ভালো মানুষ "এর সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। সেটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে নিছক লোক দেখানো ভালমানুষীতে। সেখানে ব্যক্তিস্বার্থের যুগে শিশুদের নিয়ে ভাবনার সময় কোথায়!!    
আমরা সবসময়ই শিশুদের সংবেদনশীলতা, তাদের মনোবৃত্তি বুঝতে অক্ষম। এভাবেই তারা চরম এক অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। প্রতি মুহূর্তের এই নিষ্ঠুরতা বিপন্ন করছে সমাজ ব্যবস্থাকে। মানুষের ভোগ সর্বস্বনীতি নিজের অজান্তেই মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বর্বরতার দিকে, নীচতার দিকে। রাজন থেকে রিশা - কারোর নিস্তার নেই এই বর্বর মন মানসিকতা থেকে। 
ম্প্রতি  আমাদের জাতীয় জীবনে আরেকটি আঘাতের নাম তুহিন। কতই বা বয়স এই ছোট্ট শিশুটির।  কি দোষ ছিল তার যে পৃথিবীর তামাম চালচলন, কায়দাকানুন  বুঝবার আগেই তাকে চলে যেতে হল এই পৃথিবী ছেড়ে।  মানুষের সাথে মানুষের  সম্পর্ক কাঠামো ইদানীং নির্নীত হয় স্বার্থ পূরনের নিরিখে।  সম্পর্কগুলো খুব ব্যবসায়িক। স্বার্থই সব সম্পর্কের ভিত্তি ও চালিকাশক্তি ।  কিন্তু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বাবা-চাচা কর্তৃক নিজ সন্তানের হত্যা এক নজিরবিহীন ঘটনা।  নৃশংসতা,  বিভৎসতা, ক্ষোভ,  রাগ,  হিংসা,  মানবিক অবক্ষয়,  নৈতিকতার স্খলন,  বুদ্ধিনাশ ঠিক  কি শব্দ দিয়ে পরিমাপ করা যায় এই দুস্কর্মের। এই যে সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা সেটির আদৌ কি কোন ব্যাখ্যা আছে। 
আজ পিতার কোলে তার সন্তান নিরাপদ নয়।  আইন কানুন  বিচার যুক্তি, ধর্মীয় অনুশাসন  কি দিয়ে অবসান ঘটানো যায় এই নির্মমতার। এই নৃশংস ঘটনা সম্পূরর্ণ সমাজ ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। মানুষকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।  অঙ্গুলি নির্দেশ করে তার  জীবন প্রণালীর প্রতি। মানুষের প্রতি মানুষের এই  চরম উদাসীনতা, বোধহীনতা এবং বিবেকহীনতা সমাজ ও সভ্যতার ভবিতব্য হতে পারেনা। যেখানে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম মানুষের এগিয়ে যাবার সেখানে মনুষ্যত্বের পিছু হটবার সুযোগ নেই। মৃত ধংসস্তূপ আমাদের দেশ হতে পারেনা। তাই সময় এখন সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার।  অপশক্তি নিপাত যাক। সকলে আমরা সকলের তরে প্রত্যেকে আমরা পরের তরে হয়ে উঠি অচিরেই। 

# নবনীতা চক্রবর্তী, আই. সি.সি.আর. স্কলার # এডুকেশন সেক্রেটারি, স্টেজ ফর ইয়ুথ, ঢাকা