ঢাকা, ২৯ মার্চ শুক্রবার, ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০
good-food
৩৩৭৬

সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি কতটা সৃজনশীল?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:৩০ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯  

প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এ পদ্ধতিতে পাঠদান এবং পরীক্ষা নিয়ে বিতর্ক সূচনালগ্ন থেকেই। আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় যেরূপ কাটাছেঁড়া হয়, আমার মনে হয় বিশ্বে এর নজির বিরল। ২০১০ সালের আগে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল, তার সাফাই গাওয়া আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে একটি কথাই বারবার মনে হচ্ছে, আর সেটি হলো নতুন কোনও ব্যবস্থা চালুর পূর্বে আমাদের উচিৎ যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই। আমরা জাতি হিসেবে যে বড়ই অপ্রস্তুত, তাড়াহুড়ে, হুজুগে এবং অতি অনুকরণপ্রিয় তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই তাড়াহুড়ো এবং হুজুগের প্রমাণ আছে। সম্প্রতি তাড়াহুড়ো করে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারের খেতাবে ভূষিত হন এবং এটি জাতির জন্য বড়ই লজ্জার! 
সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর আগে আমাদের মাঠ পর্যায়ে এর প্রয়োগযোগ্যতা কতটুকু যাচাই করা হয়েছিল তা একমাত্র সংশ্লিষ্টরাই জানেন। তবে আমার ধারণা এ প্রচেষ্টা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রশাসক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রথিতযশা শিক্ষা গবেষকবৃন্দ হঠাৎ করে চিন্তা করেন, ছাত্র-ছাত্রীদের মুখস্থ বিদ্যা পরিহার করতে হবে। এটি নাকি ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিক মেধা বিকাশের অন্তরায়। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল সহকারে ওই বিশেষজ্ঞদের নিকট এ বিষয়ে কোনও স্মারকলিপিও পেশ করেনি বা পড়া মুখস্ত করতে অনীহা বা অনাগ্রহ প্রকাশও করেনি। তাহলে কেন উনারা হঠাৎ মুখস্থ বিদ্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন? এ প্রশ্নের উত্তর আজও আমাদের অজানা। 
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রচার করা হয়- গাইড বই ও কোচিং নির্ভরতা কমানোর জন্য সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। আগের চাইতে ছাত্র-ছাত্রীদের গাইড বই ও কোচিং নির্ভরতা বেড়ে গেছে বহুগুণে। আরও মজার বিষয় হলো, আগে শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা গাইড নির্ভর ছিল। কিন্তু বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও গাইড বইয়ের উপর নির্ভরশীল। রিসার্চ ফর এ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন (রেইস) শীর্ষক এক জরিপে জানানো হয়েছে, মোট শিক্ষার্থীর এক চতুর্থাংশই পরীক্ষার প্রশ্ন বুঝতে অক্ষম এবং তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; বিশেষত গণিত ও সায়েন্সের অন্যান্য বিষয়সমূহ। এই জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়, শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশ গাইড বই নির্ভর। ওদের দুই তৃতীয়াংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য গৃহশিক্ষকের সাহায্য নিচ্ছে। 
অন্যদিকে শিক্ষকদের ৪৫ শতাংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন এবং তাদের ৪২ শতাংশ অল্প বুঝতে পারেন। বাকী ১৩ শতাংশ এ পদ্ধতি বুঝতেই পারেননি। আবার যারা বুঝতে সক্ষম, সেসব শিক্ষকদের অর্ধেক পড়ানোর জন্য এবং প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য গাইড বইয়ের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। কিন্তু আমার মনে হয়, সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য শতভাগ শিক্ষক গাইড বইয়ের উপর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতির নামে শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে বলে অনেকে অভিমত পোষণ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, সৃজনশীল পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না বরং এ পদ্ধতি প্রবর্তনের পর শিশুদের পাঠ্য বইয়ের বোঝা বেড়েছে। বইয়ের ব্যাগের চাপে নুয়ে পড়তে হয় কোমলমতী ছাত্র-ছাত্রীদের। এটি কোনোভাবেই অভিভাবকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। 
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি’র) মনিটরিং শাখার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ব করতে পারেনি। তাদের মধ্যে ২২ শতাংশ শিক্ষকের অবস্থা খুবই নাজুক। বাকিরা এ সম্পর্কে যে ধারণা রাখেন তা দিয়ে আংশিক প্রশ্নপত্র তৈরি করাও সম্ভব নয়। আর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও প্রায় একই রকম চিত্রের সন্ধান মিলেছে। 
বলা চলে, কোনও পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য মূল্যায়ন না করে, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া এবং গোটা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মেধা ও ধারণ ক্ষমতার বাস্তব দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়ে অনেকটা তড়িঘড়ি করে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়। আর এই অব্যবস্থাপনার খেসারত দিচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক আমাদের শিক্ষাগুরু অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জার্মান বেতার-“ডয়চে ভেলে” কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, “সৃজনশীল পদ্ধতিটা শিক্ষকরা তেমন বোঝেন না, ছাত্রদেরও বোঝাতে পারেন না। পরীক্ষার সময় এটা একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে, কী প্রশ্ন করবেন তা প্রশ্নকর্তা নিজেও বোঝেন না। ফলে তিনি নোট, গাইড বুকের উপর নির্ভর করেন। এই পদ্ধতিতে মেধার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না।” 
তিনি জানান, “সৃজনশীল পদ্ধতি চলবে না। সৃজনশীল কোনও কাজ দিচ্ছে না। মাল্টিপল চয়েসও ঠিক না।” তার মতে, “বই থেকে সরাসরি প্রশ্ন থাকবে, ছেলে-মেয়েরা লিখে জবাব দেবে। এই বিষয় সম্পর্কে সে যা জানে সেটা লিখবে। এর মাধ্যমে তার জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যাবে। ভাষা জ্ঞানেরও পরীক্ষা হবে। ভাষা জ্ঞানটাও শিক্ষা ব্যবস্থার একটা জরুরী অংশ।” 
আমি শ্রদ্ধেয় স্যারের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করছি। এমসিকিউ বা বহুনির্বাচনী প্রশ্নপদ্ধতি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নকল প্রবণতা অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে। একটি পাবলিক পরীক্ষায় বোর্ড নির্ধারিত আসন বিন্যাস অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীরা এক বেঞ্চে দুই/তিনজন বসে। সেক্ষেত্রে ইনভিজিলেটর যত সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুন না কেন প্রশ্নের উত্তর আদান-প্রদান করা কোনও ব্যাপার না। ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার হলে ইশারা ইঙ্গিত আদান-প্রদানের মাধ্যমে একে অপরের বহুনির্বাচনী পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের একাংশের মধ্যেও দূর্নীতি ও অনিয়মের প্রবণতা বেড়েছে। আরও চরম বাস্তবতা হচ্ছে সদ্য এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে মফস্বলে এমপিও ঠিক রাখার লক্ষ্যে নকল সাপ্লাইয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা প্ররোক্ষভাবে শিক্ষকবৃন্দের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। প্রশ্নপত্রে সৃজনশীল অংশে ৫/১০ নম্বর পেয়েও ওই পরীক্ষার্থী এমসিকিউ বা বহুনির্বাচনী অংশে ৩০ এর মধ্যে শুধু উত্তর আদান-প্রদানের সুযোগ থাকার কারণে ২৭/২৮ নম্বর পাচ্ছে। নি:সন্দেহে এটি একটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি ও নৈরাজ্যকর দিক বলে বিবেচিত হতে পারে। 
এ প্রসঙ্গে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এমসিকিউ বহাল রাখা নিয়ে বিতর্কে শিক্ষকবৃন্দ উল্লেখ করেন, “এমসিকিউ পদ্ধতির কারণে ভালো- মন্দের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে গেছে। বাস্তবে দেখা গেছে ক্লাসে একজন শিক্ষার্থীর ভালো পারফরম্যান্স না থাকা স্বত্ত্বেও পাবলিক পরীক্ষায় সে ভালো রেজাল্ট করছে। সহজে পাস করতে পারা, পাসের হার বৃদ্ধি এবং অধিক নম্বর পেলেও শিক্ষার্থীর মানের উন্নতি হয়নি এ পদ্ধতিতে। বরং মানের অবনতি হয়েছে বলে মনে করেন তারা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মুখস্থবিদ্যা নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি কোচিং ও গাইড নির্ভরতা কমানোর জন্য সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া তো দূরের কথা বরং বিপরীতটি ঘটতে দেখা যাচ্ছে বেশি করে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির কারণে কোচিং ও গাইড নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও বেড়ে গেছে। যে কারণে গাইড বই ও কোচিং বাণিজ্য এখন রমরমা। 
এ প্রবণতা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। মোট কথা সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন দেশে শিক্ষার বাস্তব পরিস্থিতির কথা বিবেচনা না করে খামখেয়ালী পন্থায় চালু করা হয়। সত্যি কথা বলতে কী, সৃজনশীল পদ্ধতির নামে বর্তমানে যা চলছে তা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাসের হার আগের চেয়ে বাড়লেও প্রকৃত শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে উঠছে না। বাড়ছে না শিক্ষার মান। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার এর জলন্ত উদাহরণ। এটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সৃজনশীল শিক্ষার নামে কার্যত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তথা কথিত সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে একজন শিক্ষক স্বাভাবিক পন্থায় পাঠদান করতে পারছে না শ্রেণীকক্ষে। আমি স্বীকার করছি, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থারও পরিবর্তন হওয়া উচিত। তবে সেই পরিবর্তন হতে হবে দেশের প্রকৃত বাস্তবতার নিরিখে। তবেই দেশ, জাতি তথা সমাজের উপকার হবে। একই সঙ্গে বাঙালি জাতি সম্মানের সঙ্গে তার আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। 


লেখক - মোহাঃ জালাল উদ্দীন
সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, উত্তরা কমার্স কলেজ, ঢাকা।

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর