ঢাকা, ০৭ অক্টোবর মঙ্গলবার, ২০২৫ || ২১ আশ্বিন ১৪৩২
good-food
৩৫

আর হিজিবিজি নয়,ভারতে চিকিৎসকদের হাতের লেখা ঠিক করতে বললেন আদালত

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০০:৫৩ ২ অক্টোবর ২০২৫  

আজকের যুগে যখন অধিকাংশ মানুষ লেখার জন্য কীবোর্ড ব্যবহার করে, তখন প্রশ্ন উঠেছে, হাতের লেখা কি সত্যিই এতটা গুরুত্বপূর্ণ? ভারতের আদালতের মতে, হ্যাঁ। বিশেষ করে একজন ডাক্তারের ক্ষেত্রে। ডাক্তারদের খারাপ হাতের লেখা নিয়ে সারা বিশ্বেই রসিকতা প্রচলিত। যে লেখা অনেক সময় শুধু ফার্মাসিস্টরাই বুঝতে পারেন।

 

তবে সম্প্রতি পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট স্পষ্ট করে জানিয়েছে, ‘পাঠযোগ্য মেডিকেল প্রেসক্রিপশন একটি মৌলিক অধিকার’। কারণ এটি জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে। আদালতের এই আদেশটি এমন একটি মামলার সময় এসেছে, যা লিখিত শব্দের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই মামলায় একজন নারীর ধর্ষণ, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ করেছিলেন এবং বিচারক জাস্টিস জাসগুরপ্রীত সিং পুরি ওই পুরুষের জামিনের আবেদনের শুনানি করছিলেন।

 

ওই নারী অভিযোগ করেন, অভিযুক্ত তাকে সরকারি চাকরির আশ্বাস দিয়ে অর্থ নিয়েছিলেন, ভুয়া সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এবং তাকে যৌন হয়রানি করেছেন। তবে অভিযুক্ত বলেছিলেন, তাদের সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ছিল এবং এই মামলা অর্থসংক্রান্ত বিবাদের দায়ে করা হয়েছে। অভিযোগকারী নারীর মেডিকেল রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করা হলে বিচারপতি জসগুরপ্রীত সিং পুরি জানান, সরকারি ডাক্তারের লেখা সেই মেডিক্যাল রিপোর্ট একেবারেই অপাঠ্য। তিনি বলেন, ‘একটি শব্দ বা অক্ষরও স্পষ্টভাবে পড়া যাচ্ছিল না, যা আদালতের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

 

’ বিবিসি যে কপি দেখেছে তাতে রিপোর্টের সঙ্গে দুই পাতার প্রেসক্রিপশনও ছিল, যেখানে অস্পষ্ট হাতের লেখায় ওষুধের নাম লেখা হয়েছে। বিচারপতি পুরি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘যে সময়ে প্রযুক্তি ও কম্পিউটার সহজলভ্য, সরকারি ডাক্তাররা এখনও হাতে এমন প্রেসক্রিপশন লিখছেন, যা ফার্মাসিস্ট ছাড়া কেউ পড়তে পারে না।’

 

আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, মেডিকেল স্কুলের পাঠ্যক্রমে হাতের লেখা শেখানো বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং দুই বছরের মধ্যে ডিজিটাল প্রেসক্রিপশন চালু করতে হবে। এর মধ্যে সব প্রেসক্রিপশন বড় অক্ষরে স্পষ্টভাবে লিখতে হবে। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. দিলীপ ভানুশালী বলেন, শহরাঞ্চলে ডাক্তাররা ধীরে ধীরে ডিজিটাল প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন।

 

কিন্তু গ্রাম ও ছোট শহরে হাতের লেখা প্রেসক্রিপশনই বেশি প্রচলিত। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এটি কেবল সৌন্দর্যের ব্যাপার নয়। একটি অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন ভুল চিকিৎসা ও প্রাণঘাতী পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) সভাপতি ডা. দিলীপ ভানুশালী। যাদের সংগঠনে তিন লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি ডাক্তার সদস্য রয়েছেন, বিবিসিকে বলেন, তারা ডাক্তারদের হাতের লেখাজনিত সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত।

 

ডা. ভানুশালী বলেন, ‘ডাক্তারদের হাতের লেখা খারাপ হওয়া সুপরিচিত বিষয়। তবে এর আসল কারণ হলো অতিরিক্ত ব্যস্ততা—বিশেষ করে ভিড়ে ঠাসা সরকারি হাসপাতালে কাজ করা চিকিৎসকদের পক্ষে সবসময় স্পষ্ট করে লেখা সম্ভব হয় না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের সদস্যদের সরকারি নির্দেশিকা মেনে স্পষ্ট ও বড় অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখার পরামর্শ দিয়েছি, যাতে রোগী ও ফার্মাসিস্ট উভয়ের পক্ষেই পড়া সহজ হয়। একজন ডাক্তার যদি দিনে সাতজন রোগী দেখেন, তিনি এটি সহজেই করতে পারবেন। কিন্তু দিনে ৭০ জন রোগী দেখলে তা বাস্তবে করা কঠিন।’

 

যদিও গবেষণায় প্রমাণ মেলেনি যে ডাক্তারদের হাতের লেখা স্বাভাবিকভাবে অন্যদের তুলনায় খারাপ, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে মূল সমস্যা নান্দনিকতা নয়, বরং অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশনে বিভ্রান্তি বা ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ থেকে যায়। আর এ ধরনের ভুল মারাত্মক, এমনকি প্রাণঘাতী হতে পারে।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব মেডিসিনের ১৯৯৯ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চিকিৎসাজনিত ভুলের কারণে প্রতিবছর অন্তত ৪৪ হাজার প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল ডাক্তারদের অস্পষ্ট হাতের লেখা। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডে এক নারী গুরুতর রাসায়নিক আঘাতের শিকার হন, যখন শুকনো চোখের চিকিৎসার ওষুধের পরিবর্তে ভুল করে তাকে ইরেক্টাইল ডিসফাংশনের ক্রিম দেওয়া হয়।

 

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, ওষুধ সংক্রান্ত ভুল ভয়াবহ ক্ষতি এবং মৃত্যুর কারণ হয়েছে। তারা আরো জানিয়েছে, হাসপাতালগুলোতে ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন সিস্টেম চালু করলে এমন ভুলের পরিমাণ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।

 

ভারতে খারাপ হাতের লেখার কারণে ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে তার নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল এই দেশে অতীতে অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন ভুলভাবে বোঝার ফলে বহু স্বাস্থ্যজরুরি অবস্থা এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক নারী এমন একটি ওষুধ খাওয়ার পর খিঁচুনি ও গুরুতর শারীরিক জটিলতার শিকার হন, যার নাম তার জন্য নির্ধারিত ব্যথানাশক ওষুধের নামের সঙ্গে প্রায় একরকম ছিল।

 

তেলেঙ্গানা রাজ্যের নলগোন্ডার এক ফার্মাসিস্ট, চিলুকুরি পরমাথমা বিবিসিকে জানান, ২০১৪ সালে নয়ডায় জ্বরে আক্রান্ত এক তিন বছরের শিশুকে ভুল ইনজেকশন দেওয়ায় মৃত্যুর খবর পড়ে তিনি হায়দ্রাবাদ হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন। তার প্রচেষ্টায় হাতের লেখা প্রেসক্রিপশন বন্ধ করার দাবি গুরুত্ব পায়।

 

২০১৬ সালে ভারতীয় মেডিকেল কাউন্সিল নির্দেশ দেয়। প্রত্যেক ডাক্তারকে অবশ্যই ওষুধের জেনেরিক নাম স্পষ্টভাবে এবং সম্ভব হলে বড় অক্ষরে লিখতে হবে। ২০২০ সালে ভারতের তৎকালীন জুনিয়র স্বাস্থ্যমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার চৌবে সংসদে জানান, রাজ্যগুলোর চিকিৎসা কর্তৃপক্ষকে এ নির্দেশ অমান্যকারী ডাক্তারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

 

তবে প্রায় এক দশক পার হলেও সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়নি। চিলুকুরি ও অন্যান্য ফার্মাসিস্টরা জানান, এখনও নিয়মিত অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশন তাদের কাছে আসে। তিনি বিবিসিকে কিছু প্রেসক্রিপশন দেখিয়েছেন, যেগুলো তিনি নিজেও পড়তে পারেননি। কলকাতার অন্যতম সুপরিচিত ফার্মেসি চেইন ‘ধন্বন্তরী’-এর সিইও রবীন্দ্র খণ্ডেলওয়াল বলেন, প্রায়ই তাদের দোকানে আসা প্রেসক্রিপশন এতটাই অপাঠ্য হয় যে বুঝতে সমস্যা হয়।

 

তিনি জানান, ‘বছরের পর বছর ধরে শহরাঞ্চলে প্রেসক্রিপশন হাতে লেখার পরিবর্তে মুদ্রিত আকারে আসছে। তবে শহরতলি ও গ্রামীণ এলাকায় এখনো বেশিরভাগ প্রেসক্রিপশন হাতে লেখা। অভিজ্ঞ কর্মীদের কারণে সাধারণত ওষুধ শনাক্ত করা গেলেও, মাঝে মাঝে ডাক্তারদের সরাসরি ফোন করতে হয়। খণ্ডেলওয়াল বলেন, ‘কারণ সঠিক ওষুধ সরবরাহ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

বিশ্ব বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর