ঢাকা, ০১ জুলাই মঙ্গলবার, ২০২৫ || ১৬ আষাঢ় ১৪৩২
good-food

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ত্রিপক্ষীয় জোট গঠনের কথা ভাসছে

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:০৬ ৩০ জুন ২০২৫  

ভারতকে বাদ দিয়ে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের পরিকল্পনার কথা ভাসছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে। অনেকেই ভাবছেন এই জোট সার্কের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। যদিও ভারতকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো ছোট দেশ নিয়ে চীনের জোট কতটা শক্তিশালী ও প্রভাব বিস্তারকারী হবে তা নিয়ে সন্দিহান আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের। এই জোটে চীন, পাকিস্তানের অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোকে নেয়া হবে কি না বা তারা আসবে কি না সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই। ভারতকে চাপে রাখতে চীনের এটা কৌশলও হতে পারে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।

 

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পাকিস্তান ও চীন যৌথভাবে একটি নতুন আঞ্চলিক জোট গঠনের পরিকল্পনা করছে, যা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। তবে বাংলাদেশ এবিষয়ে চীন, পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও বিকল্প জোট গঠনের কথা অস্বীকার করেছে। তবু এই উদ্যোগটি নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। 

 

এই জোট সার্কের কোনো বিকল্প নয় জানিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম. সফিউল্লাহ বলেন, সার্ক হচ্ছে আঞ্চলিক জোট। আঞ্চলিক জোটের মধ্যে এক বা একাধিক আঞ্চলিক উপ-জোট হতে পারে। এরইমধ্যে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপালকে নিয়ে বিবিআইএন নামে একটি আঞ্চলিক উপজোট রয়েছে। চীনও পাকিস্তানকে নিয়ে তেমনি একটি উপজোট করতে চেয়েছিল। এজন্য তারা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে একটি বৈঠক করেছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও চীন-তিন পক্ষই তিন রকম কথা বলেছে। পরে তিন দেশ আলাদাভাবে তিনরকম বিবৃতিও দিয়েছে। বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে বলেছে, তারা এই মূহুর্ত্তে কোনো জোটে যেতে প্রস্তুত নয়। এমনকি কোনো দেশের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশের অবস্থান নয়।

 

চীনে অনুষ্ঠেয় ওই বৈঠকের সূত্র ধরে এই কূটনৈতিক বিশ্লেষক জানান, বাংলাদেশ শুধু তাদের বক্তব্য শুনেছে। তবে অন্তবর্তী সরকারের সময় এমন বৈঠকে অংশ নেয়া এবং জোট যোগ দেয়া সংক্রান্ত বিতর্কে না জড়ানোই ভালো বলে জানান তিনি। কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে, ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দুই দেশই মনে করছে, আঞ্চলিক সংহতি ও সংযোগ বৃদ্ধির জন্য নতুন একটি সংগঠন সময়ের দাবি।

 

সম্প্রতি চীনের কুনমিং শহরে পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি ত্রিদেশীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি এই উদ্যোগেরই অংশ। এই বৈঠকে তিন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিকরা অংশ নেন। এটি এমন এক ঘটনা যা প্রতিবেশী ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত ১৯ জুন অনুষ্ঠিত কুনমিং বৈঠকের মূল লক্ষ্য ছিল সার্কের সদস্য দেশগুলোকে নতুন এই প্রস্তাবিত জোটে আমন্ত্রণ জানানো। সূত্র জানিয়েছে, ভারতকেও এই নতুন ফোরামে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হবে। তবে ভারতের স্বার্থ ও অবস্থান ভিন্ন হওয়ায় তারা ইতিবাচক সাড়া দেবে, এমন সম্ভাবনা খুব কম।

 

তবে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ এই নতুন জোটে যোগ দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আঞ্চলিক বাণিজ্য, সংযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। যদি এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়, তবে সার্কের কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। একসময় সার্ককে দক্ষিণ এশিয়ার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) বলে অভিহিত করা হতো। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের কারণে এটি কখনোই তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।

 

সার্ক সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করেছিল এক দশক আগে। ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ভারত বয়কট করে। সেই সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারও ভারতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সম্মেলনে যোগ না দিয়ে বর্জন করে। এর পর থেকে সার্ক পুনরুজ্জীবিত করতে কোনো বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদিও পাকিস্তান সম্মেলন আয়োজন করতে আগ্রহী ছিল।

 

সম্প্রতি সার্ক আরো একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে, যখন ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের জন্য সার্কের অধীনে বিশেষ ভিসা সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যা পেহেলগাম হামলার পর ঘটে। পাকিস্তান ও চীন গত কয়েক মাস ধরেই এই নতুন জোট নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে সমমনা দেশগুলোকে একত্রিত করে ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী একটি জোট গড়া উচিত।

 

পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত তার ভিন্নমতপূর্ণ অবস্থানের কারণে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর মতো অন্যান্য আঞ্চলিক জোটেও নিজেকে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক মনে করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসসিও-এর শেষ দুটি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি। এই দশ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা জোটে চীন, রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ রয়েছে। চীন ও রাশিয়ার উপস্থিতির কারণে এসসিও-কে অনেক সময় পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক জোট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসসিও-এর এজেন্ডার সঙ্গে ভারত ক্রমশ দূরত্ব তৈরি করছে।

 

তবে গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, আমরা কোনো জোট গঠন করছি না। মূলত উদ্যোগটি চীনের এবং এটি একেবারেই অফিশিয়াল পর্যায়ে, এটা রাজনৈতিক কোনো পর্যায়ে না। এক প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, ওখানে (কুনমিংয়ে) একটা প্রদর্শনী হচ্ছিল, সেখানে সাইডলাইনে তিন দেশের পররাষ্ট্রসচিব বসে আলাপ-আলোচনা করেছি। আলাপ-আলোচনা পুরোপুরি ছিল কানেকটিভিটি (সংযুক্তি), ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি; এগুলোর বিষয় নিয়ে। আপনারা জোট গঠনের যে কথা বলছেন, এ ধরনের কোনো কিছু এটাতে ছিল না। এটা নিতান্তই একটি প্র্যাকটিক্যাল (বাস্তবসম্মত) সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির ব্যাপার। আমরা মনে হয় না, এটাকে নিয়ে এর চেয়ে বেশি আর কোনো কিছু হতে দেওয়া উচিত। এ বিষয়টা এভাবেই আমাদের দেখতে হবে।

 

কুনমিংয়ের ওই বৈঠকে তিন পক্ষের সহযোগিতা বাস্তবায়নে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে চীন ও পাকিস্তানের প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে। তবে বিষয়টির উল্লেখ নেই বাংলাদেশের বিজ্ঞপ্তিতে। বৈঠক নিয়ে তিন দেশের বিজ্ঞপ্তির এই অমিল স্পষ্ট।

 

তবে কি বাংলাদেশ জোট গঠনের কথা অস্বীকার করছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আসলে আমাদের কোনোটাই ডিনাই (অস্বীকার) করার প্রয়োজন নেই। আমরা আমাদের (বিজ্ঞপ্তিতে) যেটুকু উল্লেখ করেছি, এটাতে বোঝা যায় এটাতে স্ট্রাকচার্ড (কাঠামোগত) বড়সড় কোনো ব্যাপার ছিল না। প্রত্যেকটা দেশ এটাকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছে। আমরাও তাই করেছি। এটার যদি ভবিষ্যতে কোনো অগ্রগতি আরও কিছু হয় তখন আপনারা জানতে পারবেন। আরও স্ট্রাকচার্ড কিছু হয়, সেটা আমি আপনাদের সময়মতো জানাব।

 

ত্রিপক্ষীয় যে জোট গঠনের কথা আসছে, এটা তৃতীয় কোনো দেশকে লক্ষ্য করে করা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, এটা অবশ্যই তৃতীয় কোনো পক্ষকে টার্গেট করছে না। এটা আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি। টার্গেট করার কোনো ব্যাপার এখানে নেই। এ রকম আরো কোনো দেশ যদি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করতে চায়, আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না। সেটাও আমি করতে রাজি আছি।

 

তৌহিদ হোসেন বলেন, ধরুন, ভারত যদি করতে চায় কানেকটিভিটি নিয়ে, নেপাল, বাংলাদেশ বা ভারত একসঙ্গে বসুক কানেকটিভিটি ইত্যাদির ব্যাপারে আমি কালকেই রাজি আছি। যেহেতু চীন ও পাকিস্তান ছিল, এ কারণে হয়তো আপনারা মনে করছেন হঠাৎ করে কেন হলো। যদি এটা এমন তিনটা দেশের ব্যাপারে হতো, যেখানে এ ধরনের কনট্রোভার্সি (বিতর্ক) আপনাদের মনে থাকত না তাহলে হয়তো এটা লক্ষই করা হতো না।

 

ত্রিপক্ষীয় বিষয়টি বাংলাদেশ অস্বীকার করছে কি না, জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, তিন পক্ষ তো একসঙ্গে বসেছে। এটা নিয়ে খুব বেশি স্পেকুলেট (জল্পনা করা) করার সুযোগ নেই। স্পেকেলুশনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে শুধু দেশ তিনটার নামের কারণে। এ ছাড়া এটাতে বাকি সবকিছু এমন ছিল, যেগুলো নিয়ে স্পেকুলেট করার সুযোগ আছে।

বিশ্ব বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর