ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর রোববার, ২০২৪ || ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৫৩

আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে যা বললেন ড. ইউনূস

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১১:৪৮ ১৯ নভেম্বর ২০২৪  

আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে কিনা– এমন প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এটা ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। বিএনপি এটা করেছে। তারা বলেছে, সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সুতরাং তারা ইতোমধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান দলের মতামতকে উপেক্ষা করব না। 

 

তাহলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আপনার কোনো আপত্তি নেই– সে প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কোনো একটি দল বা আরেকটি দলকে বেছে নেয়ার জন্য আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমি রাজনীতিকদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করছি।

 

সোমবার (১৮ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় ভারতের ‘দ্য হিন্দু’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে খেলাপি ঋণসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগ ও সেগুলোর সফলতার কথা তুলে ধরেন ড. ইউনূস।

 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দেয়া বিবৃতির কথা তুলে ধরে সাংবাদিক প্রধান উপদেষ্টার কাছে জানতে চান, নতুন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সময় আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত থাকার বিষয়ে তিনি কতটা আত্মবিশ্বাসী?

 

জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেননি।’ তখন ভারতের গণমাধ্যমের সাংবাদিক বলেন, ‘তিনি দিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে।’ জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘ভালো। এখন বাংলাদেশ ও সংখ্যালঘুদের বিষয়ে বলি। সম্ভবত তিনি সঠিকভাবে অবগত নন। এটা অপপ্রচার, যা বিশ্বজুড়ে চলছে। কিন্তু যখন তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বাস্তবতা সম্পর্কে জানবেন, তখন ট্রাম্প অবাক হবেন, তাকে কতটা ভিন্নভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানানো হয়েছে।

 

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি মনে করি না, শুধু যুক্তরাষ্ট্রে একজন নতুন প্রেসিডেন্টের কারণে সবকিছু বদলে যাবে। পররাষ্ট্রনীতি ও দেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট পদে পরিবর্তনের কারণে সাধারণত পরিবর্তিত হয় না। তা ছাড়া ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যদি পরিবর্তন হয়ও, তাহলে আমাদের মনে রাখতে হবে এটাও বাংলাদেশ-২, যেটাকে আমরা বলছি– নতুন বাংলাদেশ। সুতরাং আমরা অপেক্ষা করব এবং যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আসেন ও দেখেন এবং আমাদের অর্থনীতি যদি ভালো করতে থাকে, তাহলে তারা খুবই আগ্রহী হবেন। তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সরকারি ক্রেতা; আমাদের দিক থেকেও তাই। এটা খুবই ভালো সম্পর্ক, যা আমরা বছরের পর বছর গড়ে তুলেছি। আমাদের আশা, এটা আরো জোরদার হবে।

 

প্রশ্নকর্তা বলেন, ট্রাম্পের কথাকে আপনি অপপ্রচারের ফল বলছেন। কিন্তু শুধু তিনি নন; ভারত সরকার বাংলাদেশে হিন্দুদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে; বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যা করা হয়েছে; এমনকি ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটি বিবৃতি দিয়েছে। আপনি এটার ক্ষেত্রে কী বলবেন?

 

জবাবে ড. ইউনূস বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে প্রথম ফোনকলে (১৬ আগস্ট) তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে এবং এ রকম আরো অনেক কিছু। আমি তাকে খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলাম, এগুলো অপপ্রচার। অনেক সাংবাদিক এখানে আসার পর কিছু উত্তেজনা নিয়ে কিছু খবর প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু মিডিয়ায় যেভাবে এসেছে, সেভাবে হয়নি।

 

প্রশ্নে বলা হয়, তাহলে এর পেছনে কে আছে বলে আপনি মনে করেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি জানি না। কিন্তু এসব প্রচারণা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। সব ঘটনার পেছনে এক দল ব্যক্তি রয়েছেন।

 

সাংবাদিক বলেন, আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আতঙ্কিত বোধ করছিলেন। তাদের মনে হচ্ছিল, তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। ফেসবুক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ভিডিও আছে, যেগুলোতে বলা হয় যে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ হবে। এখন ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের আমরা বলতে শুনেছি যে, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিতে সংস্কার হচ্ছে। এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে, বাংলাদেশে পরে কী হচ্ছে এবং গত ১৬ বছরের তুলনায় আপনার সরকারের সময়ে অনেক ইসলামের প্রভাব দেখছি। এসব সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করতে এগুলো কাজে দেবে?

 

এর জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এটা কি আমার সঙ্গে যায়? উপদেষ্টা পরিষদের প্রত্যেক সদস্য হয় মানবাধিকার কর্মী, যারা নিজেরা ভুক্তভোগী হয়েছেন, অথবা পরিবেশ অধিকারকর্মী, অথবা নারী অধিকার বা অন্য অধিকারকর্মী। সুতরাং তারা সবাই অধিকারকর্মী। আপনি যেসব কথা বললেন, সেগুলো যদি তাদের সামনে বলেন, তাহলে তারা আপনার ওপর ক্ষেপে উঠবে। উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যদের প্রত্যেকের জীবনের অতীত কর্মকাণ্ড দেখুন।

 

ভারতের গণমাধ্যমের ওই সাংবাদিক বলেন, মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু সেপ্টেম্বরেই রাজনৈতিক সহিংসতায় ৮৪১ জন আহত হন; আটজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আমরা জানতে পেরেছি, অনেক সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, আপনার সরকার অতীতের আচরণ অব্যাহত রেখেছে।

 

জবাবে ড. ইউনূস বলেন, মানুষকে বিচার করতে দিন। এই সরকার কী করেছে এবং অন্য সরকার কী করেছে, তা তুলনা করে দেখুন। আমি বিতর্ক করতে যাচ্ছি না। আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছি। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অ্যাক্রিডিটেশন আইন আমরা প্রণয়ন করিনি। আমরা শুধু এর প্রয়োগ করেছি এবং আপনি এটা নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন, এই প্রয়োগ সঠিক কিনা। আমি আইনটি পরিবর্তনের পক্ষে।

 

সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ৫ আগস্টের ঘটনা কীভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে? এটা কি একটা ধাক্কা হিসেবে এসেছে?

 

ড. ইউনূস বলেন, এটা কেন হবে? বাংলাদেশ এমন একটি শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে, যেখানে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে; অনেকে নিহত হয়েছেন; অনেককে গুম করা হয়েছে; অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের এ মুক্তিকে বন্ধু দেশ হিসেবে ভারতের উদযাপন করা উচিত। অনেক রাষ্ট্র যেমনটি করেছে, তেমন ভারতেরও আমাদের তরুণদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত এবং একসঙ্গে উদযাপন করা উচিত।

 

আপনি বলেছেন, ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি দুই সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে– এমন প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, (শেখ হাসিনা) অন্তত এ সময় ভারতে অবস্থান করছেন; এটা কোনো সমস্যা নয়। বাংলাদেশ নিয়ে তার কথা বলাটা সমস্যা। তিনি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, আর সেগুলো রাজনীতি নিয়ে। তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন; এটাই সমস্যা।

 

হিন্দু’র সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সেটা কীভাবে? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, তিনি (হাসিনা) মানুষকে (ঘর থেকে) বেরিয়ে আসতে বলছেন; ঢাকা ও অন্যান্য শহরের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে বলছেন। তার অডিও ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে তিনি তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি (ঢাল হিসেবে) সঙ্গে রাখতে বলছেন, যেন পুলিশ বাধা দিলে তারা বলতে পারেন, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এটি অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ।

 

তাকে দেশে ফেরাতে সরকার ইন্টারপোলের দ্বারস্থ হয়েছে। ভারতকে সরাসরি এ অনুরোধ করা হলো না কেন? এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থা রয়েছে।– এমন প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, তাকে ফিরিয়ে আনতে আমরা সব আইনি পথ অবলম্বন করব। সাংবাদিক প্রশ্ন করে বলেন, প্রকৃতপক্ষে এখনো আপনার সরকার (শেখ হাসিনার) প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানায়নি। (ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে) একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি মনে করি, কিছু আইনি ধাপ রয়েছে। আমরা সেগুলোর দিকে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা এখনো ওই পর্যায়ে পৌঁছাইনি।

 

সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিচার করা হচ্ছে– এমন যুক্তি দেখিয়ে ভারত যদি (বাংলাদেশের) অনুরোধ না রাখে, তাহলে কী হবে? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আপনি কি বলছেন, ভারত চুক্তি লঙ্ঘন করবে? হ্যাঁ, চুক্তিতে এমন কিছু ধারা রয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার যদি শেখ হাসিনাকে সেখানে রাখতে এগুলো প্রয়োগ করে, তাহলে সেটা আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলবে না। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ খুব কম। তাই এ সময়ে হয়তো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সবকিছু মীমাংসা করা যাবে না। তবে আমাদের পরে যে সরকারই আসুক না কেন, তারা এটা ক্ষমা করবে না।