ঢাকা, ২৭ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৪৫০

করোনাকাল : ষড়যন্ত্র ও ভুয়া তথ্য ছড়ায় কারা-কেন-কীভাবে?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:০৬ ৫ মে ২০২০  

করোনাভাইরাসের প্রকোপ সারা বিশ্বে যেমন দ্রুত ছড়িয়েছে, তেমনি লাগামহীন ভাবে এই ভাইরাস নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভুয়া তথ্য আর নানা জল্পনা। কিন্তু কারা শুরু করছে এসব গুজব? কারাই বা ছড়াচ্ছে এগুলো?

 

এই মহামারির সময় বিবিসি এধরনের কয়েকশ ভুয়া তথ্য তদন্ত করেছে। এর থেকে বিবিসির একটা ধারণা জন্মেছে এসব বিভ্রান্তিকর তথ্যের হোতা কারা - আর কেনই বা তারা এগুলো করছে।

 

সাত ধরনের মানুষ আছে যারা এসব মিথ্যা খবর শুরু করে এবং ছড়ায়।

 

রসিক বা ভাঁড়

 

লন্ডনের মানুষকে খাওয়ানোর জন্য শহরের বিশাল ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে সরকার বিপুল পরিমাণে রান্নার আয়োজন করেছে, হোয়াটসঅ্যাপে সরকারি বার্তা বলে এমন একটা ভয়েস মেসেজ পেলে সেটা কি আসলে বিশ্বাস করা উচিত? কিন্তু অনেক মানুষ আছেন যারা তা বিশ্বাস করেন। এটা ব্যঙ্গ না রসিকতা না কি ভাঁড়ামো, তা তারা ধরতে পারেন না- বিশেষ করে এই কঠিন সময়ে।

 

আরেকটি উদাহরণ - রসিকতা করতে সরকারের নামে এমনই একটি ভুয়া বার্তা তৈরি করেছিল এক ব্যক্তি। বিভিন্ন লোকের কাছে সেই মেসেজ পাঠিয়ে বলা হয়েছিল - আপনি বাসা থেকে খুব বেশি বেশি বের হয়েছেন। ফলে আপনাকে জরিমানা করা হয়েছে। ওই ব্যক্তি মনে করেছিল যারা লকডাউন বিধি মানছে না এতে তারা ভয়ে পেয়ে ঘরে থাকবে।

 

ওই ব্যক্তি তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তার অনুসারীদের মেসেজটি শেয়ার করারও পরামর্শ দিয়েছিল। মেসেজটি খুবই সিরিয়াসলি নেয় কিছু মানুষ এবং একসময় ওই এলাকার উদ্বিগ্ন বাসিন্দারা তাদের ফেসবুক গ্রুপে সেটি পোস্ট করে।

 

"আমি ত্রাস সৃষ্টি করতে চাইনি," ওই ব্যক্তি জানায়।

 

তার আসল নাম সে কোথাও প্রকাশ করেনি। তবে মেসেজ যারা সত্যি হিসাবে নিয়েছে দোষটা তাদের ঘাড়েই চাপিয়ে সে লিখেছে: "সামাজিক মাধ্যমে সব স্ক্রিনশট কি বিশ্বাস করতে হবে? ইন্টারনেটে তথ্য কীভাবে যাচাই বাছাই করতে হয় তা আসলে বুঝতে শিখুন।"

 

প্রতারক


আরেকদল মানুষ আছে যারা এই মহামারির মওকায় কিছু অর্থ কামাতে সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের নাম দিয়ে ভুয়া টেক্সট ছড়াচ্ছে।

 

এরকম একটি প্রতারণামূলক টেক্সট ছড়ানো হয় মার্চ মাসে। দাবি করা হয় সরকার ত্রাণ বাবদ মানুষকে অর্থসাহায্য দেবে। তাই মানুষকে তাদের ব্যাংকের বিস্তারিত তথ্য জানাতে বলা হয়।

 

এই টেক্সট বার্তার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে অনেকে। কিন্তু যেহেতু এটি টেক্সটের মাধ্যমে ছড়ানো হয়, তাই এর হোতা কে তা খুঁজে বার করা কঠিন।

 

ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে ভুয়া তথ্য দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করছে কিছু প্রতারক।

 

ইমেলের মাধ্যেমেও ভুয়া খবর দিয়ে অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার চেষ্টা চলছে। যেমন "করোনাভাইরাসের চিকিৎসা বিষয়ে জানতে ক্লিক করুন" বা "এই প্রাদুর্ভাবের কারণে আপনি কর ফেরত পাবেন"।

 

রাজনীতিক


শুধু ইন্টারনেট জগতের অজানা ও গুপ্ত অপরাধীদের কাছ থেকেই যে এধরনের ভুয়া খবর আসছে তাই নয়।

 

গত সপ্তাহে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশ্ন তোলেন করোনাভাইরাসের রোগীর শরীরে অতি-বেগুনি রশ্মি দিয়ে বা ব্লিচ জাতীয় জীবাণুনাশক ইনজেকশন দিয়ে তাকে সারিয়ে তোলা সম্ভব কি না। এটা ছিল পুরো একটা জল্পনা এবং প্রকৃত তথ্যকে আমলে না নিয়ে করা মন্তব্য।

 

পরে অবশ্য তিনি বলেছিলেন ব্যঙ্গ করে একথা তিনি বলেন। কিন্তু তার ওই মন্তব্যের সূত্র ধরে বহু মানুষ হটলাইনে ফোন করে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় জীবাণুনাশক ব্যবহার করা যাবে কি না তা জানতে চান।

 

শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্টই নন, চীনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন যে কোভিড নাইনটিন উহানে নিয়ে এসেছে আমেরিকান সেনাবাহিনী।

 

রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এবং ক্রেমলিনপন্থী টুইটার অ্যাকাউন্টে এই ভাইরাস প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

 

ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদী


এই ভাইরাস নিয়ে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে তার সুযোগ নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানাধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।

 

ব্রিটেনে ভ্যাকসিন গবেষণার ট্রায়ালে অংশ নেয়া প্রথম ভলান্টিয়ার মারা গেছেন এমন একটি ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেন ভ্যাকসিন বিরোধী ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদ্ভাবক বেশ কিছু ফেসবুক গ্রুপ। খবরটি অবশ্যই ছিল ভুয়া।

 

করোনাভাইরাস ছড়ানোর সঙ্গে ফাইভ-জি-র যোগাযোগ রয়েছে বলে ইউটিউবে পোস্ট করা ডেভিড আইক নামে একজনের সাক্ষাৎকার ফাইভ জি নিয়ে ভুয়া খবরটির জন্ম দিয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি পরে সরিয়ে নেয়া হয়।

 

মি. আইক পরে লন্ডনের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আসেন। ব্রিটেনের সম্প্রচার মান ভঙ্গ করার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয় ওই চ্যানেলের বিরুদ্ধে। তার ফেসবুক পেজ পরে বন্ধ করে দেয়া হয়। ফেসবুক জানায় "তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য ক্ষতিকর" এই কারণ দেখিয়ে তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

 

ওই ভুয়া খবরের জের ধরে ব্রিটেনে ফাইভ-জি ফোনের সিগনাল মাস্তুলের ওপর বেশ কয়েকটি হামলা চলানো হয়।

 

ভেতরের লোক


অনেক সময় ভুল খবর আসে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও। যেমন চিকিৎসক, অধ্যাপক, বা হাসপাতাল কর্মী।

 

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই "ভেতরের লোকরা" গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন।

 

যেমন একটি খবর ছড়ান ইংল্যান্ডের এক নারী। খুবই ত্রস্ত কণ্ঠে রেকর্ড করা ওই বার্তায় তরুণ ও সুস্থ করোনা রোগীদের মধ্যে ভয়াবহ মৃত্যুর হার সম্পর্কে তিনি আশংকাজনক পূর্বাভাষ দেন, যা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

 

ওই নারী বলেন তিনি অ্যম্বুলেন্সে কাজ করেন এবং কাজের সূত্রে ভেতরের খবর তিনি জানেন।

 

মন্তব্য করার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি উত্তর দেননি। তিনি যে আসলেই স্বাস্থ্যকর্মী তার পক্ষে কোন প্রমাণ দেবার অনুরোধেও সাড়া দেননি। বিবিসি অনুসন্ধানে জেনেছে তার দাবি অসত্য।

 

আত্মীয়স্বজন


সাধারণত উৎকণ্ঠিত গলায় রেকর্ড করা বার্তা বা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে লেখা মেসেজ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। তারা এইসব মেসেজ বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করে।

 

অনেককেই ফেসবুকে এধরনের মেসেজ দিয়ে লিখতে দেখা গেছে "যদি সত্যি হয়ে থাকে"।

 

এক নারী বলেছেন, "প্রথমে মনে হয়েছিল এটা ঠিক কি না। কিন্তু আমার আর বোনের একেবারে ছোট বাচ্চা আছে। আমার একটু বড় বয়সের বাচ্চাও আছে। আমাদের বাসায় ঝুঁকির অনেক কারণ আছে।"

 

এরা ভাবেন অন্যদের সাহায্য করছেন তথ্য দিয়ে। কিন্তু তারা অবশ্যই জানেন না যেসব মেসেজ তারা শেয়ার করছেন তা সঠিক নয়।

 

তারকা ও ব্যক্তিত্ব

 

শুধু আপনার চাচা চাচী বা পরিবারের অন্য ঘনিষ্ঠজনই নন, সামাজিক মাধ্যমের মূলধারায় ভুয়া খবর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে অনেকসময় থাকেন তারকা বা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও।

 

বেশ কিছু খবর এভাবে ছড়ানোর পেছনে গায়ক, অভিনেতারাও আছেন।

 

রয়টার্স ইনস্টিটিউট তাদের এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখেছে সামাজিক মাধ্যমে তারকাদের অনুসারীর সংখ্যা যেহেতু অনেক, তাই তাদের পোস্ট থেকে আসা খবর খুব দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়ে। মানুষ সেগুলো বিশ্বাসও করে।

 

শুধু সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম নয়, টেলিভিশনেও অনেক সময় মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের মতামত, মন্তব্য মানুষ গুরুত্বের সঙ্গে নেয় এবং তা ছড়িয়ে দেয় সামাজিক মাধ্যমে।

 

করোনাভাইরাসের বিস্তারের সঙ্গে ফাইভ জি-র যোগাযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভিত্তি রয়েছে বলে ব্রিটেনের এক পরিচিত সাংবাদিকের মন্তব্য এধরনের বিভ্রান্তিমূলক খবরে ইন্ধন জুগিয়েছিল। পরে অবশ্য তিনি স্বীকার করেন তার মন্তব্য 'অবিবেচকের মত' ছিল।

অপরাধ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর