ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৫৫০

জানতেন না ওই কিশোরী-তরুণীরা

গর্ভনিরোধক যন্ত্র বসানোই আছে শরীরে!

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৫:৪৭ ২৭ ডিসেম্বর ২০২২  

বেবিয়ানে তখন সবে ২১ বছরে পা রেখেছেন, ঠিক করেছেন শরীরে গর্ভনিরোধ কয়েল বসাবেন। কিন্তু তা বসাতে গিয়ে জানতে পারেন, তার শরীরে আগে থেকেই ওই কয়েল বসানো।

 

বেরিয়ানের মতো হাজার হাজার নারী তো বটেই, বাদ যায়নি কিশোরীরাও; অজান্তে তাদের গর্ভে বসানো হয়েছে গর্ভনিরোধ যন্ত্র।

 

গ্রিনল্যান্ডে ক্রমেই বাড়তে থাকা আদিবাসী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ষাট ও সত্তরের দশকে ডেনমার্ক এক কর্মসূচির আওতায় তা করেছে।

 

তবে হালে ড্যানিশ সরকার ’কয়েল ক্যাম্পেইন’ নাম পরিচিতি পাওয়া এই ঘটনার স্বাধীন তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে।

 

তদন্তে যেন আরও অগ্রগতি ঘটে, সবার এমন আহ্বানের মধ্যেই বিবিসি অনিচ্ছাকৃত এই জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে নারীদের মতামত সংগ্রহ করেছে।  

 

নিজের উপর চালানো অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মসূচির বিষয়টি যখন বুঝতে পারেন বেরিয়ানে, সেই সময় নিজের মনের অবস্থা কেমন ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ”আমার মনে আছে, আমার চোখ দিয়ে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল তখন। আমি তাদের বলেছিলাম, এই কয়েল কী করে আমার শরীরে বসানো হল, আমি তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না... কেন আমি মনে করতে পারছি না কবে আমি এই কয়েল বসিয়েছিলাম শরীরে?”


২০০০ সালে বেবিয়ানের বয়স ছিল ১৬ বছর। তখন একবার গর্ভপাত করিয়েছিলেন তিনি। বেবিয়ানের ধারণা, সেই সময়ই তাকে না জানিয়ে ওই কয়েল তার শরীরে বসানো হতে পারে।

 

এরপর চার বছর তাকে তলপেটের তীব্র ব্যথায় ভুগতে হয়েছিল। যন্ত্রণা এতটাই বেড়েছিল যে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারতেন না আর।

 

বেবিয়ানে বলেন, “আমি অনেকবারই হাসপাতাল গিয়েছি, কিন্তু তারা কিছুতেই বলতে পারত না কেন এমন হচ্ছে। পিরিয়ডের সময় এই ব্যথা শুরু হত, কিন্তু যখন পিরিয়ড চলত না তখনও ব্যথা হত।” 

 

 এই নারী আবার গর্ভধারণ করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি গর্ভবতী হতে সফল হলেন না। এরপর তিনি গর্ভধারণের চেষ্টা থেকে কয়েক মাসের বিরতি দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় বন্ধুরা তাকে বিভ্রান্তিকর পরামর্শ দেয়; শরীরে গর্ভনিরোধ কয়েল বসালে তা প্রজনন সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।

 

বন্ধুদের পরামর্শ অবশ্য মেনে নিয়েছিলেন বেবিয়ানে। এরপরই তিনি জানতে পারলেন, শরীরে আগে থেকেই ওই কয়েল বসানো রয়েছে।

 

এরপর কয়েল অপসারণ করেন বেবিয়ানে এবং কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি গর্ভধারণ করেন।

 

মিরার (ছদ্মনাম) অভিজ্ঞতা খুব বেশিদিন আগের নয়। ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় চিকিৎসক তাকে জানালেন, শরীরে গর্ভনিরোধক কয়েল বসানো রয়েছে।

 

“শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম,”  বলেন তিনি।

 

তার অজান্তে কখন এই কয়েল শরীর বসানো হতে পারে?


২০১৮ সালে জরায়ুতে ছোট একটি অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন মিরা। ধারণা করছেন, তখনই এই কয়েল তার শরীরে স্থাপন করা হয়।

 

ওই অপারেশনের পর পেটে অসম্ভব ব্যথা হত তার। শুরুতে চিকিৎসক তার এই সমস্যা আমলে নিতে চাইছিলেন না । এরপর পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে গিয়ে ওই কয়েল ধরা পড়ে শরীরে।

 

৪৫ বছর বয়সী মিরা বলেন, এই কয়েল তার জরায়ু ফুটো করে দিয়েছে বলে চিকিৎসক তাকে জানিয়েছেন।

 

স্বাস্থ্য জটিলতায় অবসাদগ্রস্ত মিরার উপলব্ধি হয়, এই কয়েল থেকেই এতো যন্ত্রণার সূত্রপাত। এরপর জরায়ুই অপসারণ করে ফেলেন তিনি।

 

কিন্তু এই অপারেশনের পরও তার জটিলতা লাঘব হয়নি। মিরা এখন আর যৌন সম্পর্কে যেতে পারেন না। কারণ তাতে প্রতিবারই রক্তপাত হয় এবং যন্ত্রণা বাড়তেই থাকে।

 

গ্রিনল্যান্ডের নারী জনগোষ্ঠীর অনুমতি ছাড়া তাদের শরীরে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রই বসানো হয়েছে, তা নয়।

 

২০১১ সালে গর্ভপাত করিয়েছিলেন আন্নিতা (ছদ্মনাম)। এরপর তিনি বাহুতে একটি দানা অনুভব করেন, যা ব্যান্ডেজ করা ছিল। ড্যানিশ চিকিৎসককে এ নিয়ে প্রশ্নও করেন তিনি।

 

একটি ছোট, নমনীয় প্লাস্টিক রড বসানো হয়েছিল আন্নিতার বাহুর উপরের দিকে ত্বকের তলে; যা গর্ভনিরোধক হিসেবে কাজ করবে।



৩১ বছর বয়সী আন্নিতা বলেন, চতুর্থবারের মতো গর্ভপাত করিয়েছিলেন বলে তার শরীরে ওই যন্ত্র বসানোর কথা তাকে ব্যাখ্যা হিসেবে জানিয়েছিলেন চিকিৎসক।

 

“এটা খুবই ভয়ঙ্কর ছিল ... তিনি সত্যিই সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন ... আমি রীতিমত অসম্মানিত বোধ করেছিলাম,” বললেন তিনি।

 

আন্নিতা এই যন্ত্র শরীর থেকে অপসারণ করার কথা জানালেও, চিকিৎসক তাতে আগ্রহী হলেন না। পরে আন্নিতা ব্যান্ডেজ সরিয়ে নিজেই ওই যন্ত্র শরীর থেকে বার করে আনতে উদ্যত হন। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসক যন্ত্রটি অপসারণ করে করেন আন্নিতার শরীর থেকে।  

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৮ বছর বয়সী সারা জানালেন একই রকম অভিজ্ঞতার কথা।

 

২০১৪ সালে হঠাৎ গর্ভপাত ঘটে গেলে তাকে জেনারেল অ্যানাস্থেটিক দেওয়া হয়। ওই সময় ড্যানিশ নার্স তাকে গর্ভনিরোধ ডিপো প্রভেরা ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন।

 

“আমি এর কিছুই জানতাম না, আমি চাই কিনা তা ওই নার্সও জানতে চাইনি আমার কাছে। শুধু বলা হল, প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর আমাকে হাসপাতালে এসে এই ডোজ নিতে হবে।”

 

সারা বলেন, নার্স তাকে ওই ওষুধের নামও জানাননি। তবে সারা পরে এই ওষুধ নিয়ে বিস্তারিত জানতে অনলাইনে খোঁজ করেন।

 

তিনি আরও কয়েক বছর এই ওষুধ নিতে থাকার সিদ্ধান্তও নেন। এরপর যখন তিনি ও তার স্বামী সন্তান নিতে আগ্রহী হলেন, তখন ওষুধের ডোজ নেওয়া বন্ধ করে দেন সারা। কিন্তু ওষুধ নেওয়া বন্ধ করলেও গর্ভবতী হতে আরও কয়েক বছর সময় লেগে যায় তার। 

 

ডিপো প্রোভেরা ওষুধের প্রভাব মাসিকে ১২ মাসের জন্য হতে পারে, এমন কথাও তাকে জানানো হয়নি।

 

এই উদ্বেগ নিয়ে দুই বছর মেয়াদি তদন্ত শুরু করতে গত সেপ্টেম্বরে ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ডের হাতে স্বাস্থ্য খাত আসার পর ১৯৯১ পর্যন্ত কী ঘটেছিল, তা খতিয়ে দেখা হবে তদন্তে। 

 

তবে বিবিসি যাদের সঙ্গে কথা বলেছে, ওই নারীরা নিজেদের অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে এই তদন্তে খুব বেশি সক্ষমতা দেখছেন না। 


বেবিয়ানে বলেন, “আমি তো চাইব এই তদন্ত ১৯৯১ সাল পর্যন্ত হয়ে যেন থেমে না যায়। আজকের দিনেও নারীর সম্মতি ছাড়া গর্ভনিরোধক দেওয়া হচ্ছে, তাও তদন্তে আসা দরকার।”

 

গ্রিনল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিমি কার্লসেন বিবিসিকে বলেন, সম্মতি ছাড়াই নারীর শরীরে গর্ভনিরোধক বসানোর সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে তিনি অবগত নন।

 

“যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে এমন করে থাকে... যা আসলে আইন, নৈতিকতা ও সেবাকাজের লঙ্ঘন, আমাদের অবশ্যই এসব নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানো দরকার।”

 

এখন কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে তা নিয়ে মিমি কার্লসেন বলেন, বিবিসির দেওয়া এই তথ্য জাতীয় স্বাস্থ্য বোর্ডের কাছে জমা দেবেন তিনি।

 

প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হবেন, এ ধরনের ঘটনা ব্যাপক হারে ঘটছে কি না এবং পুরনো স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে এর যোগসূত্র কতটুকু রয়েছে।  

 

একটি ড্যানিশ পডকাস্ট থেকে এসব ঘটনা পুনরায় নজরে এলে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

 

ইংরেজিতে ‘কয়েল ক্যাম্পেইন’ নামে ওই পডকাস্ট অনুসারে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সালে গ্রিনল্যান্ডের সাড়ে চার হাজার নারী ও কিশোরীর শরীরে ‘লিপিস লুপ’ বসানো হয়। গ্রিনল্যান্ডে ওই সময় নয় হাজার প্রজনন সক্ষম নারীর মধ্যে অর্ধেকের সঙ্গে এই ঘটনা ঘটে।

 

কারণ কিশোরী মেয়েদেরও গর্ভবতী হওয়ার হার বেড়ে যাচ্ছিল, যা ড্যানিশ কর্তৃপক্ষকে সতর্কবার্তা দেয়।

 

১৯৭০ সালে যখন প্রজনন হার ভীষণ ভাবে কমতে শুরু করে তখন এই কর্মসূচিকে সফল বলে মনে করা হয়। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪, এই আট বছরে নারী সাতটি সন্তান থেকে নেমে এসেছিল দুই দশমিক তিন সন্তানে।  

 

ডেনমার্কের বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাগনাস হেউনিক বলেন, এই কর্মসূচি কখন স্থগিত করা হয়েছিল তা কোনো নথি উল্লেখ নেই; যা খুঁজে বার করা হবে তদন্তের একটি দিক। 

 

তিনি বলেন, “আমার ভয় হচ্ছে, এটা হয়ত একটি ঘটনা হবে, যা দশকের পর দশক ধরে চালু রাখা হয়েছে।”

 

কয়েক বছরের যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে ১৭ বছর বয়সে শরীর থেকে কয়েল অপসারণ করেন নাজা। এরপর দীর্ঘসময় সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। অবশেষে ৩৫ বছর বয়সে তিনি সন্তান ধারণ করেন।


নাজার বন্ধু হোলগা দীর্ঘদিন যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। গর্ভধারণেও ব্যর্থ হচ্ছিলেন তিনি।

 

কিন্তু চিকিৎসকরা এক বাক্যে তাকে জানিয়ে দিতেন, কোনো সমস্যা নেই। কোনো রকম পরীক্ষাও করা হয়নি হোলগাকে।

 

হোলগা এখন মনে করতে পারছেন না, কত বছর বয়সে শরীরে ওই কয়েল বসানোর কথা জানতে পারেন তিনি এবং কবে ওই কয়েল অপসারণ করেছেন। 

 

হোলগা আর কখনই গর্ভ ধারণ করতে পারেননি।

 

লিপেস লুপের কারণে দেখা দেওয়া স্বাস্থ্য জটিলতায় চিকিৎসক তাকে জরায়ু অপসারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি জরায়ু অপসারণ করেন।

 

৭৫ বছর বয়সী সুসান কিয়েলসেনের অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে আতংকের বলে জানাচ্ছে বিবিসি।

 

দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভবতী হয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গেলে চিকিৎসক তাকে বলেন, আগের কিছু গাইনি সংক্রান্ত ঝুঁকির কারণে তার গর্ভপাত করানো জরুরি।

 

পাঁচ মাসের গর্ভবতী সুসান কিয়েলসেন বলেন, এই জটিলতা গর্ভ ধারণের আগেই শনাক্ত হয়েছিল এবং এরপরও তিনি গর্ভকালে ভালো ছিলেন।

 

এরপরও গর্ভপাতের প্রস্তুতি নেন চিকিৎসকরা। তাকে প্রায় ৩১টি ইঞ্জেকশন দেওয়া হলেও গর্ভের সন্তান তখনও জীবিত ছিল।

 

সাত মাসের সময় সন্তান প্রসব করেন তিনি। কিন্তু জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই সন্তানের মৃত্যু ঘটে।

 

অন্যদিকে ওই সময় চিকিৎসকরা তার শরীরে কয়েল বসাতে চারবার চেষ্টা চালান। শেষ পর্যন্ত সুসান কিয়েলসেন তাদের থামতে বলেন।  

 

সন্তান হারানো এই মা বলেন, “আমি কল্পনার আমার ছেলেকে দেখতে পাই, সে কাঁদছে। এই দুঃখ আমাকে কাবু করে বারবার।” 

 

সুসান কিয়েলসেন বলেন, “অনেক দেরি হওয়ার আগেই আমি চাই, ড্যানিশ কর্তৃপক্ষ যেন এই ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।”