ঢাকা, ২৭ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪ || ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১৯৪

চীন ও তাইওয়ান: কার সামরিক সক্ষমতা কত?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১১:৩৪ ৪ আগস্ট ২০২২  

যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরে যাওয়ার নিন্দা করে চীন একে "চরম বিপজ্জনক" বলে আখ্যা দিয়েছে। ২৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম শীর্ষস্থানীয় কোনো আমেরিকান রাজনীতিক দ্বীপটিতে গেলেন।
চীন তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটা প্রদেশ হিসেবে দেখে এবং তারা চায় দ্বীপটি আবার বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে আসবে।

 

তবে তাইওয়ান মনে করে, তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তাদের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে এবং রয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, তাইওয়ানের সঙ্গে "পুনরেকত্রীকরণ" "অর্জন হবেই" এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দেননি।


তাইওয়ান একটি দ্বীপ, দক্ষিণ পূর্ব চীনের উপকূল থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১০০ মাইল। দেশটি তথাকথিত "প্রথম সারির দ্বীপপুঞ্জের" মধ্যে একটি। এই সারিতে রয়েছে আমেরিকার বন্ধুপ্রতিম অঞ্চলগুলো। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির জন্য এই দ্বীপগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ বলছেন, চীন যদি তাইওয়ানের দখল নিতে পারে, তাহলে চীন প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে অবাধে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারবে এবং সেটা আরও দূরে গুয়াম ও হাওয়াইতে যে আমেরিকান সামরিক ঘাঁটিগুলো আছে - সেগুলোর জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। কিন্তু চীন জোর দিয়ে বলছে তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ।

 

ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলছে, তাইওয়ান প্রথম পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণে আসে ১৭০০ শতাব্দীতে যখন কিং রাজবংশের শাসনামল শুরু হয়। এরপর ১৮৯৫ সালে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে হেরে যাবার পর চীনকে এই দ্বীপটি তুলে দিতে হয় জাপানের হাতে।

 

এরপর জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার পর ১৯৪৫ সালে চীন আবার জাপানের কাছ থেকে দ্বীপটি নিয়ে নেয়।
কিন্তু মূল চীনা ভুখণ্ডে চিয়াং কাই-শেক-এর নেতৃত্বাধীন দেশটির জাতীয়তাবাদী সরকারি বাহিনী এবং মাও-এর কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ঐ যুদ্ধে জয়ী হয়ে ১৯৪৯ সালে কম্যুনিস্টরা বেইজিংয়ে ক্ষমতায় বসে।

 

চিয়াং কাই-শেক এবং তার জাতীয়তাবাদী দলের তখনও যেটুকু অবশিষ্ট ছিল- যারা পরিচিত ছিল কুয়োমিনটাং নামে - তারা পালিয়ে যায় তাইওয়ান দ্বীপে। পরবর্তী বেশ কয়েক দশক তারা ওই দ্বীপ শাসন করে।

 

চীন এই ইতিহাস উল্লেখ করেই দাবি করে থাকে, তাইওয়ান শুরু থেকেই চীনের একটি প্রদেশ ছিল। কিন্তু তাইওয়ানিরা আবার একই ইতিহাসের কথা বলে যুক্তি দেখায়, ১৯১১ সালের বিপ্লবের পর প্রথম যে আধুনিক চীনা রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল অথবা তারও পরে মাওয়ের অধীনে যে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়, তারা কখনই তার কোনো অংশ ছিল না।

 

চিয়াং কাই-শেক ১৯৪৯ সালে কম্যুনিস্টদের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে তাইওয়ানে পালিয়ে যাবার পর কুয়োমিনটাং-এর নেতৃত্ব দেন। সেই সময় থেকেই কুয়োমিনটাং ছিল তাইওয়ানের সবচেয়ে পরিচিতি প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলোর একটি। যারা তাইওয়ানের ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য সময় জুড়ে দ্বীপটি শাসন করেছে।

 

বর্তমানে মাত্র ১৩টি দেশ এবং ভাটিকান তাইওয়ানকে সার্বভৌম একটি দেশের স্বীকৃতি দেয়। তাইওয়ানকে স্বীকৃতি না দেবার জন্য অথবা স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে এমন ধারণা না দেবার জন্য চীন অন্যান্য দেশের ওপর প্রবল কূটনৈতিক চাপ দিয়ে থাকে।

 

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গত ৪০ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন অসামরিক পথে তাইওয়ানের সাথে "পুনরেকত্রীকরণ"এর চেষ্টা করতে পারে। যেমন অর্থনৈতিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করার মাধ্যমে। তবে সামরিক সংঘাতে জড়ালে তাইওয়ানের সশস্ত্র বাহিনী চীনের সামরিক সক্ষমতার কাছে নগণ্য হয়ে যাবে।

 

আমেরিকা ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে চীন। নৌবাহিনীর শক্তি থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, বিমান ও সাইবার হামলার সক্ষমতা - সব দিক দিয়েই চীনের শক্তি অনেক বেশি। চীন তার সামরিক শক্তি ব্যবহার করে থাকে অন্যত্র। কিন্তু সক্রিয় সেনা মোতায়েনের সার্বিক ক্ষমতা দিয়ে বিচার করলে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে ভারসাম্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ।

 

যদি মুখোমুখি লড়াই শুরু হয়, তাহলে কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞের অনুমান, তাইওয়ান চীনের হামলার ব্যাপকতা যাতে কম হয় সেজন্য চেষ্টা চালাবে, তারা চেষ্টা করবে চীনের জল ও স্থলে একসঙ্গে হামলা চালাতে সুদক্ষ অ্যাম্ফিবিয়ান বাহিনীর উপকূলে নামা ঠেকাতে। বাইরের দেশগুলো থেকে সাহায্য না আসা পর্যন্ত গেরিলা আক্রমণ চালাতে। বাইরের সাহায্য আসবে আমেরিকা থেকে, যারা তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে।

 

এ যাবৎ ওয়াশিংটন "অস্পষ্ট কৌশল"এর যে নীতি নিয়েছে, তার অর্থ হলো চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে আমেরিকা তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা দেবে কিনা বা দিলে কীভাবে সেটা দেবে সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখা। কূটনৈতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে "এক চীন" নীতির সমর্থনে অটল রয়েছে, যে নীতি মেনে তারা শুধু বেইজিংয়ের চীনা সরকারকেই স্বীকৃতি দেয়। তাইওয়ানের বদলে চীনের সাথেই আনুষ্ঠানিক যোগাযাগ রাখে।
তবে মে মাসে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃশ্যত ওয়াশিংটনের অবস্থান আরও কঠোর করেছেন।

 

তাইওয়ান আক্রান্ত হলে আমেরিকা তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা দেবে কিনা এ প্রশ্নে বাইডেনের উত্তর ছিল: "হ্যাঁ।" হোয়াইট হাউস জোর দিয়ে বলেছে, ওয়াশিংটন তার অবস্থান বদলায়নি। চীন ২০২১ সালে তাইওয়ানের বিমান প্রতিরক্ষা এলাকার ভেতর সামরিক বিমান পাঠিয়ে দ্বীপটির ওপর চাপ কার্যত বাড়িয়েছিল। এটি একটি স্ব-ঘোষিত প্রতিরক্ষা বলয় যার ভেতর বিদেশি বিমান ঢুকলে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে শনাক্ত করা হয়, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

 

তাইওয়ান ২০২০ সালে এই সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সর্বাধিক সংখ্যক চীনা বিমান সেখানে ঢোকে। ওই মাসে একদিন চীনা বিমান ওই এলাকায় ৫৬বার অনুপ্রবেশ করে।


তাইওয়ানের অর্থনীতির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। সারা বিশ্বে দৈনন্দিন ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি - ফোন থেকে ল্যাপটপ, ঘড়ি থেকে কম্পিউটর গেমসের কনসোল - সব কিছুই চালায় যে কম্পিউটার চিপস তার সিংহভাগ তৈরি হয় তাইওয়ানে। একটি হিসাব অনুযায়ী - শুধু একটিমাত্র তাইওয়ানিজ কোম্পানি - তাইওয়ান সেমিকন্ডাকটার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বা টিএসএমসি- বিশ্ব বাজারের অর্ধেকের বেশি কম্পিউটার চিপস উৎপাদন করে।

 

টিএসএমসি একটি "উৎপাদন কারখানা" - এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা ভোক্তা এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজাইন করা চিপস তৈরি করে। এটি একটি বিশাল শিল্প যার ব্যবসার পরিমাণ ২০২১ সালে ছিল ১০ হাজার কোটি ডলার।

 

চীন যদি তাইওয়ান দখল করে নেয়, তাহলে বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্প বেইজিং নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে সম্প্রতি উত্তেজনা বাড়া সত্ত্বেও জরিপ বলছে, তাইওয়ানের বহু মানুষ এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না।

 

তাইওয়ান পাবলিক ওপিনিয়ন ফাউন্ডেশন ২০২১ সালের অক্টোবরে মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিল তারা কি মনে করে - এই উত্তেজনার জেরে শেষ পর্যন্ত চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ লাগবে? তাদের দুই-তৃতীয়াংশের (৬৪.৩%) উত্তর ছিল, তারা সেটা মনে করে না।

 

আরেকটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, তাইওয়ানের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের তাইওয়ানিজ বলে পরিচয় দেয় - যা সম্পূর্ণ আলাদা একটা পরিচিতি। ন্যাশানাল চেংচি ইউনিভার্সিটির ১৯৯০এর প্রথম দিকের পর থেকে চালানো জরিপে দেখা যাচ্ছে - তাইওয়ানে চীনা অথবা একই সঙ্গে চীনা ও তাইওয়ানিজ বলে পরিচয় দেওয়া মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। সেখানে বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের তাইওয়ানিজ বলে মনে করেন।

বিশ্ব বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর