ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১১৩১

পশ্চিমবঙ্গে প্রথম হানা

উপকূলে আছড়ে পড়লো সুপার সাইক্লোন আমফান

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৭:২৬ ২০ মে ২০২০  

অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আমফান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আছড়ে পড়ার পর স্থলভাগে উঠে আসতে শুরু করেছে।

 

ভারতের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বুধবার স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটার দিকে এ ঝড় পশ্চিমবঙ্গের দীঘার কাছাকাছি এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করা শুরু করে।  

 

বিশাল বাসের এ ঝড় পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসতে ঘণ্টা চারেক সময় লাগতে পারে। 

 

ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আমফান আঘাত হানার সময় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটারের মধ্যে।

 

সে সময় এর অবস্থান ছিল ভারতের সাগরদ্বীপ থেকে ৩৫ কিলোমিটার, দীঘা থেকে ৬৫ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়া থেকে ২২৫ কিলোমিটার দূরে।


ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় প্রবল ঝড়ো বাতাস বয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে ভারি বৃষ্টি।ৎ

 

যেসব এলাকা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে পারে সেগুলোকে ‘রেড প্লাস জোন’ ঘোষণা করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার পুরো রাত কন্ট্রোল রুমে অবস্থান করবেন বলে জানিয়েছেন।

 

বৃহস্পতিবার দুর্যোগ কেটে যাওয়ার ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে বাইরে বের না হতে অনুরোধ করেছেন তিনি।

 

ভারতের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় আম্পান ওড়িশার পারাদ্বীপ থেকে ১৫০ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরপূর্বে, পশ্চিমবঙ্গের দীঘা থেকে ৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্বে, সাগরদ্বীপ থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়া থেকে ২৬০ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

 

পটুয়াখালীতে সিপিসি সদস্য খালে নিখোঁজ

 

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি- সিপিপির এক সদস্য নৌকা উল্টে নিখোঁজ হয়েছেন। মো. শাহআলম নামের ওই ব্যক্তি বুধবার সকালে ছৈলাবুনিয়া গ্রামের হাফেজ পেয়াদা খালে এই স্বেচ্ছাসেবী নিখোঁজ হন।

 

সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে

 

জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্রের উপসচিব কাজী তাসমীন আরা আজমিরী জানিয়েছেন, বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত উপকূলীয় জেলাগুলোর ১৩ লাখ ৬৪ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। এই কাজ অব্যাহত রয়েছে।

 

তিনি বলেন, “মঙ্গলবার যাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছিল রাতে ঝড় আসেনি বলে তাদের অনেকে বাড়ি চলে যায়। আবার তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হচ্ছে। লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান আগের দিন জানিয়েছিলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এর কারণে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৫১ লাখ ৯০ হাজার ১৪৪ জন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া গেলেও কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হবে। সেজন্য ২০ থেকে ২২ লাখ লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এর আগে ঘূর্ণিঝড় ফণির সময় ১৮ লাখ এবং বুলবুলের সময় ২২ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল।

 

চট্টগ্রাম-কক্সবাজারেও মহাবিপদ সংকেত

ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশ উপকূলের ৩৫০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসার পর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরেও ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।

 

মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে বুধবার সকাল ৬টা থেকেই ১০ নম্বর ‘মহাবিপদ সংকেত’ জারি রয়েছে।

 

সকাল ৯টার বুলেটিনে আবহাওয়া অফিস বলেছে, তখন ঘূর্ণিঝড় আম্পান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

 

ঘূর্ণিঝড় আম্পান: মহাবিপদ সংকেত  

 

আবহাওয়ার সর্বশেষ বুলেটিনে বলা হয়, উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় আম্পান উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

 

বুধবার সকাল ৬টায় ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪১০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

 

তখন ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

 

 বুধবার বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে সুন্দরবনের কাছ দিয়ে অতি প্রবল এ ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। তখন এর বাতাসের শক্তি থাকতে পারে ঘণ্টায় প্রায় দেড়শ কিলোমিটার বা তার বেশি।

 

ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশ উপকূলের ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসার পর মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর ‘মহাবিপদ সংকেত’ দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।

 

পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরকে আগের মতই ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

 

উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

 

উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

 

১০-১৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস

 

২২ মে অমাবস্যা থাকায় দ্বিতীয় পক্ষের চাঁদের শেষ দিন বুধবার, সেই সঙ্গে সাগরে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়। এর প্রভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে জোয়ার।

 

আবহাওয়া অফিস বলছে, ঝড়ের সময় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০-১৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

 

ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।

 


সুন্দরবন ঘেঁষেই উপকূলে আঘাত

 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান তার বর্তমান অবস্থান থেকে আরও উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে সুন্দরবনের কাছ দিয়ে বুধবার বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

 

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বুধবার প্রথম প্রহরে (রাত ১২ টায়) অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

 

তখন ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

 

অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড়টি এরই মধ্যে শক্তি কিছুটা হারিয়ে, তার এগোনোর গতিও কমেছে। একদিন আগেও ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে বাতাসের বেগ ২৭০ কিলোমিটারে উঠেছিল। আর ১২ ঘন্টা আগেও ঝড়টি ২০ কিলোমিটার বেগে এগোচ্ছিল উপকূলের দিকে।

 

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে দুপুরের পর থেকে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর পাশাপাশি ঢাকাতেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। সন্ধ্যার পর বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করেছে।

 বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বর্ষণ ধীরে ধীরে বাড়বে, বুধবার বিকাল থেকে ভারি বর্ষণ হবে।

আবহাওয়া অফিস বলছে, মধ্যরাত থেকে উপকলীয় এলাকাসহ দেশের সর্বত্র বৃষ্টির প্রবণতা বাড়বে। তাতে গত কয়েক দিনের গরম কিছুটা কমবে।

ভারতীয় উপকূলে ঝড়ো হাওয়া

আনন্দবাজার জানিয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় জেলাগুলোতে দমকা হওয়া বইতে শুরু করেছে। কলকাতাতেও চলছে হালকা বৃষ্টি।

ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ৮টায় ওড়িশার পারাদ্বীপ থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে এবং পশ্চিমবঙ্গের দীঘা থেকে ৪৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। বাংলাদেশের খেপুপাড়া থেকে দূরত্ব ছিল ৬১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে।

মঙ্গলবার রাত ৯টায় অবস্থান

অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান মঙ্গলবার রাত ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

ওই সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।


ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে উত্তাল বঙ্গোপসাগর, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। ছবি: সুমন বাবুঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে উত্তাল বঙ্গোপসাগর, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। ছবি: সুমন বাবুকখন কোথায় আঘাত
বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস বলছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পান আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বুধবার বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড়ের আকারে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। তখন এর বাতাসের শক্তি থাকতে পারে ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার।

ভারতের আবহাওয়া অফিস বলছে, সুপার সাইক্লোনে পরিণত হওয়া আম্পানের শক্তি মঙ্গলবার কিছুটা কমে এসেছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আকারে সেটি বুধবার বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের দীঘা এবং বাংলাদেশের হাতিয়ার মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

সে সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার হতে পারে, যা ঘণ্টায় দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ১৮৫কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

 

জলোচ্ছ্বাস-বৃষ্টির পূর্বাভাস

বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস বলছে, ২২ মে অমাবস্যা থাকায় এর প্রভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে জোয়ার।

 ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বুধবার দিনের প্রথম ভাটা শুরু হবে বেলা ১১টা ৫৩ মিনিটে আর দিনের দ্বিতীয় জোয়ার শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ২৩ মিনিটে। এরপরের ভাটা রাত ১২টা দুই মিনিটে শুরু হবে।

আম্পান বুধবার বিকালে উপকূল অতিক্রম শুরু করলে তখন ভাটার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস কিছুটা কম থাকবে। তবে সন্ধ্যায় জোয়ারের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম জেলা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।


ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে মঙ্গলবার ভোলায় সতর্কতামূলক প্রচারণায় সিপিপি সদস্যরা।ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে মঙ্গলবার ভোলায় সতর্কতামূলক প্রচারণায় সিপিপি সদস্যরা।বাংলাদেশে প্রস্তুতি
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাত ৮টার মধ্যে ২২ লাখ মানুষকে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট হওয়ায় সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধি মেনে লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আসবেন, তাদের সবাইকে মাস্ক পরে আসতে বলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের থাকতে হবে অন্তত এক মিটার দূরত্ব রজায় রেখে।

>> ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধার ও জরুরি ত্রাণ তৎপরতার জন্য। পাশাপাশি উপকূলীয় সেনা ক্যাম্পগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।

>> যারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাবেন, তাদের জন্য ৩ হাজার ১০০ মেট্রিক টন চাল, ৫০ লাখ নগদ টাকা, শিশু খাদ্য কিনতে ৩১ লাখ টাকা এবং গোখাদ্য কিনতে জেলা প্রশাসকদের ২৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ৪ হাজার ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার পাঠানো হয়েছে উপকূলীয় জেলাগুলোতে।

>> সিভিল সার্জনদের নেতৃত্বে প্রতি জেলায় মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধসহ ওইসব টিম প্রস্তুত রয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, সাইক্লোন শেল্টারে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ গেলে বিকল্প ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

>> এলজিইডিকে বলা হয়েছে, যেসব অঞ্চলের লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হবে, সেসব অঞ্চলের সড়ক এবং ব্রিজে কোনো সমস্যা হলে জরুরিভত্তিতে তা মেরামত করতে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কোনো বাঁধ ভেঙে গেলে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে তা মেরামত করে দেবে।

>> চট্টগ্রাম, খুলনা ও মোংলা নৌঅঞ্চলে সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় দ্রুততম সময়ে জরুরি উদ্ধার, ত্রাণ এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য নৌবাহিনীর ২৫টি জাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে।


ভারতে প্রস্তুতি

>> রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকজনকে এক হাজার সাইক্লোন শেল্টারে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। 

>> ওড়িশার স্পেশাল রিলিফ কমিশনার পি কে জানার বরাত দিয়ে এনডিটিভি লিখেছে, উপকূলের নিচু এলাকায় কাঁচা ঘরে বসবাস করে এমন বাসিন্দাদের মঙ্গলবারই সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে ১১ লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার পরিকল্পানা হয়েছে ওড়িশায়।

>> আনন্দবাজার জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের তিন জেলা থেকে প্রায় ৩ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। সুন্দরবন এলাকায় এক ব্যাটালিয়ন বিএসএফ মোতায়েন করেছে ভারত সরকার। আরও এক ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছে ইছামতী নদীতে।

>> বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের অন্তত ৩৭টি দলকে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় চলছে মাইকিং।

সারাদেশে নৌ চলাচল বন্ধ

>> ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকায় সারা দেশে ফেরিসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

>> বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান খাজা মিয়া জানান, মঙ্গলবার বেলা ১টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশের পাঁচটি ফেরিঘাট দিয়ে কোনো ফেরি চলাচল করবে না।

>> নভেল করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে সারা দেশে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল গত ২৬ মার্চ থেকেই বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পণ্যবাহী নৌযান এর আওতার বাইরে ছিল। এখন ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসায় সব ধরনের নৌযান চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিএ এর জনসংযোগ কর্মকর্তা মোবারক হোসেন মজুমদার জানান।

আবার সুন্দরবন?

>> জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার আম্পানের সম্ভাব্য যে গতিপথ দেখিয়েছে, তাতে উপকূল অতিক্রম করার সময় এ ঝড়ের কেন্দ্র বা চোখ থাকতে পারে সুন্দরবনের কাছাকাছি। ভারতের আবহাওয়া অফিসও সুন্দরবনের কাছ দিয়ে আম্পানের স্থলভাগে উঠে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে।

>> সাম্প্রতিক অতীতে ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডরও স্থলভাগে উঠে এসেছিল সুন্দরবন উপকূল দিয়ে। এর মধ্যে আইলায় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার। আর সিডরের শক্তি ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি, ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার।

>> সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় বুলবুল গতবছর নভেম্বরে ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে একই দিক দিয়ে উপকূলে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলকে অনেকটাই রুখে দেয় সুন্দরবন।

>> সিডরের উৎপত্তি যেখানে ছিল, আম্পানের উৎপত্তিও বঙ্গোপসাগরের একই এলাকায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছে। গত ডিসেম্বরে আঘাত হানা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মতোই এগোচ্ছে আম্পান। গত বছরের মে মাসে আরেকটি শক্তিশালী ঝড় ফনীও একই পথে আঘাত হেনেছিল।

>> আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত কারণে ঘূর্ণিঝড় এ অঞ্চলকে ‘চ্যানেল’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রূপ নেওয়ার পর ডান দিকে মোড় নেয়। এবারও তাই হয়েছে।

“আম্পানের ব্যাস বেশ বড়। এ ধরনের ঝড় শেষ মুহূর্তেও সামান্য দিক পরিবর্তন করতে পারে। এটি উড়িষ্যা উপকূল হয়ে উত্তর দিকে সরে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূলে আসবে। এবারও সুন্দরবন অংশ পাবে।”

রেকর্ড ভাঙা ঝড়

>> ভারতের বেসরকারি আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থা স্কাইমেটের প্রধান মহেশ পালাওয়াটের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা লিখেছে, এই শতাব্দীতে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া প্রথম সুপার সাইক্লোন আম্পান। অবশ্য উপকূলে পৌঁছানোর আগেই শক্তি কমে তা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। 

>> এর আগে ২০০৭ সালের জুনে আরব সাগরে সুপার সাইক্লোন 'গোনু' তৈরি হয়েছিল, যা পরে ওমানের দিকে সরে যায়।

>> মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আম্পান ঘূর্ণিঝড় থেকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে, যেটি ‘একটি রেকর্ড’ বলে জানাচ্ছেন মহেশ।

 

সুপার সাইক্লোন

 

>> ঘূর্ণিঝড় আম্পান আরও শক্তি সঞ্চয় করে ১৭ মে বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টা নাগাদ পরিণত হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে এর চোখ বা কেন্দ্র একটি স্পষ্ট আকার পায় এবং শক্তি বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টার মধ্যে সেই ঝড় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়।  

>> জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার বলেছে, মাত্র ছয় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে এ ঝড় ক্যাটাগরি ওয়ান থেকে ক্যাটাগরি ফোর মাত্রার হারিকেনের শক্তিসম্পন্ন ঝড়ে পরিণত হয় এবং সোমবার বিকালে পরিণত হয় ক্যাটাগরি ফাইভ মাত্রার হারিকেনের শক্তিসম্পন্ন সুপার সাইক্লোনে।

>> ভারতীয় আবহাওয়া অফিস বলছে, সোমবার বিকালে এই সুপার সাইক্লোনের বাতাসের শক্তি ঘণ্টায় ২৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল। মধ্যরাতে তা আরও বেড়ে ঘণ্টায় ২৬৫ কিলোমিটার হয়।

>> ঘণ্টায় গড়ে ২০ কিলোমিটার গতিতে উপকূলের দিকে এগোতে থাকা সুপার সাইক্লোন আম্পানের শক্তি মঙ্গলবার কিছুটা কমে আসে। ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী বেলা ১২টায় এ ঝড়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি বাতাস বইছিল ঘণ্টায় ২০০ থেকে ২১০ কিলোমিটার বেগে, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ২৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

আমপানের উদ্ভব

>> ১৬ মে প্রথম প্রহরে বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে তা শক্তি সঞ্চয় করে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। আরও ঘণীভূত হয়ে সেই রাতেই তা পরিণত হয় ঘূর্ণিঝড়ে।

>> বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপের নির্ধারিত তালিকা থেকে এ ঝড়ের নাম দেওয়া হয় ‘আম্পান’। এটি থাইল্যান্ডের দেওয়া নাম।