ঢাকা, ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০
good-food
৭২৮

এরশাদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল ভারতের?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:০৭ ১৪ জুলাই ২০১৯  

প্রয়াত জেনারেল এইচ এম এরশাদের মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর টুইট করেছেন, ভারতের সঙ্গে বিশেষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তার অবদান বাংলাদেশে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

মূলত একজন সামরিক শাসক হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে এরশাদের যে বেশ নিবিড় সম্পর্ক ছিল, দিল্লিতেও পর্যবেক্ষকরা তা এক বাক্যে স্বীকার করেন। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও সেই ঘনিষ্ঠতায় ভাঁটা পড়েনি।

ভারতের কোচবিহারে মি এরশাদের পারিবারিক শিকড় এবং পরে সেদেশের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে তার সামরিক প্রশিক্ষণও হয়তো এই সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে যে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেন, তখন ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত মুচকুন্দ দুবে।

পরে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হয়ে অবসর নেয়া মি. দুবে এদিন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, একজন সামরিক শাসক হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক বরাবরই যথেষ্ট ভালও ছিল। পরবর্তী প্রায় নয় বছরে যেটা বারবার দেখা গেছে।

মি দুবে জানাচ্ছেন, শুরু থেকেই আমার সঙ্গে ওনার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। নিজের প্রত্যেকটা মুভ নিয়েও আমাকে সেসময় অবহিত রাখতেন তিনি। এমনকি ক্ষমতা দখলের আগেও জানিয়েছিলেন। আর সেসময় আমাদের এছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। ঘটনাপ্রবাহ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল তিনিই ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন। আর কে গণতান্ত্রিক, কে স্বৈরতন্ত্রী - ওগুলো তখন বিচার করার মতো অবস্থাও ছিল না। এরশাদ সামরিক শাসক বলে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলব, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক ওভাবে চলেও না।

তিনি বলেন, বাস্তবতা হল, তার আমলে সাঙ্ঘাতিক কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি না-হলেও বড় কোনও সঙ্কটও কিন্তু হয়নি। আমি বলব, এরশাদ একটা ভিন্ন ধরনের সরকার চালিয়েছিলেন। যার সঙ্গে লম্বা সময় পর্যন্ত ভারত স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পেরেছে।

জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে শীতলতা তৈরি হয়েছিল, সেটা এরশাদের সময় অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশেনে সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্তর মতে, ভারতের নেতা নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সৌহার্দ্যও এই আড়ষ্টতা দূর করতে সাহায্য করেছিল।

: দত্তর কথায়, জিয়াউর রহমানের সময়কার 'স্টিফনেস' এরশাদের সময় অনেক কমে গিয়েছিল। তখন ভারতের বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে তার যে সব কথাবার্তা হত, যে বৈঠকগুলো হত, তাতে বেশ উষ্ণতাও থাকত। এমনকি ৯১- পরেও তার জাতীয় পার্টি সেদেশের রাজনীতির মূল ধারায় একটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছে। আর এই পুরো সময়কালটা জুড়ে তিনি ভারত ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে গেছেন। আমিও কখনও এদেশের মিডিয়ায় বা ভারতের নেতাদের মুখে, এমনকি একান্ত আলোচনাতেও, এরশাদের কোনও সমালোচনা শুনিনি। বরং বাংলাদেশে তার করা বিভ্ন্নি রিফর্মস নিয়ে চিরকাল প্রশংসাই কানে এসেছে।

প্রেসিডেন্ট এরশাদ কীভাবে গোটা বাংলাদেশকে প্রশস্ত পিচ রাস্তায় মুড়ে দিয়েছেন অথবা সফলভাবে সেদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অভিযান চালাচ্ছেন, সেই বিবরণ তখন ভারতীয় মিডিয়ায় ফলাও করে বের হতো। ভারতের সঙ্গে এরশাদের আর একটা যোগসূত্র ছিল জন্মস্থান দিনহাটা - কোচবিহারের যে মহকুমা শহরে তিনি স্কুলজীবন পর্যন্ত কাটিয়েছিলেন। ওই জেলার প্রয়াত রাজনীতিবিদ ফরোয়ার্ড ব্লকের বিখ্যাত নেতা কমল গুহ ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

তারই ছেলে বর্তমানে বিধায়ক উদয়ন গুহ বিবিসিকে বলছিলেন, বাবার সঙ্গে একই ক্লাসে উনি দিনহাটা হাই স্কুলেই পড়তেন, যেখানে পরে আমিও পড়াশুনো করেছি। স্কুলে উনি ছিলেন সবার প্রিয় 'পেয়ারাদা'। দিনহাটা ছেড়ে বহু বছর আগে চলে গেলেও এই জায়গাটার প্রতি ওর অদ্ভুত টান ছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার অগে-পরেও বহুবার এসেছেন, এখানে ওদের পারিবারিক বাড়ি ভিটে এখনও আছে। আর দিনহাটায় এসেই পুরনো বন্ধুবান্ধবদের খোঁজ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিলেন উদয়ন গুহ বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পরও এসে খুঁটিয়ে খোঁজ নিতেন, কমলের ছেলে এখন কী করছে, মেয়েরা কোথায় আছে এই সব!জীবনযাপনে খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটাও রাখতেন। আর দিনহাটার কেউ বাংলাদেশে গেলে তো কথাই নেই, যে করে হোক তার সঙ্গে দেখা করতেনই! শেষবার যখন দিনহাটায় এলেন দু-তিনবছর আগে, তখন খুবই ভগ্নস্বাস্থ্য - চেহারাও রুগণ! কিন্তু তারপরও পুরনো বন্ধুরা যারাই আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সবার বাড়িতে গেলেন। এই জিনিসগুলো ওনার মধ্যে ছিল।

শেষবার মি এরশাদ ভারত সফরে এসেছিলেন গত বছরের জুলাইতেই। বাংলাদেশের নির্বাচনও তখন অদূরেই। সেই যাত্রায় দিল্লিতে ভারতের বহু গুরুত্বপূর্ণ নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেও তার অবশ্য দিনহাটা যাওয়া হয়নি। আর তাকে নিয়ে বাংলাদেশে যা- বিতর্ক থাক, ভারত যে তাকে একজন ব্যতিক্রমী বন্ধু হিসেবেই বরাবর দেখে এসেছে তাতে কোনও সংশয় নেই।