ঢাকা, ৩০ মে শুক্রবার, ২০২৫ || ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
good-food
২৪

অপরাধ জগতে সুব্রত-মাসুদের উত্থান সিনেমার গল্পকেও হার মানায়

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:৫৯ ২৮ মে ২০২৫  

সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের অপরাধ জগতে উত্থান যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। তাদের সম্পর্কে ছিলেন গুরু-শিষ্যের। অপরাধ জগতের এমন কোনো উপমা নেই যা তাদের নামের সঙ্গে যায় না। ঢাকার অন্ধকার জগতে তাদের নামেই এক সময় কাঁপত পুরো নগরী। তাদের উত্থান শুধু অপরাধ জগতের চিত্রই বদলে দেয়নি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাথাব্যথারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সেনাবাহিনীর হাতে একসঙ্গে গ্রেফতারের পর আবারও আলোচনার শীর্ষে। 

 

সুব্রত বাইন

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জোবারপাড় গ্রামের সন্তান সুব্রত বাইন। জন্ম ১৯৬৭ সালে। পিতা বিপুল বাইন, পেশায় একটি এনজিওর গাড়িচালক। মায়ের নাম কুমুলিনি বাইন। চার ভাইবোনের মধ্যে সুব্রত সবার বড়। শৈশবে মা ও তিন বোনকে নিয়ে ঢাকার মগবাজারে ভাড়া বাসায় ওঠেন তারা।

 

বরিশালের খ্রিষ্টান মিশনারি পরিচালিত অক্সফোর্ড মিশন স্কুলে হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন সুব্রত। এরপর ঢাকায় এসে শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই এসএসসি পাশ করেন। পরে সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানেই পরিচয় ঘটে এক ‘নেতা’র সঙ্গে। সেই পরিচয়ই যেন তাকে অপরাধজগতে টেনে আনে। আর কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছাটাও সেখানেই হারিয়ে যায়।

 

মগবাজার এলাকায় দ্রুতই একটি গ্যাং গড়ে তোলেন সুব্রত বাইন। নাম দেওয়া হয় ‘সেভেন স্টার’। সেই গ্যাং এক সময় দাপিয়ে বেড়াত ঢাকার অপরাধজগৎ। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিকের ছত্রছায়ায় সুব্রতের অপরাধী আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদ হত্যা মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন।

 

১৯৯৩ সালে মধুবাগে এক সবজি বিক্রেতা হত্যাকাণ্ডে প্রথম পুলিশের নজরে আসেন। পরে মগবাজারের বিশাল সেন্টারের নির্মাণকাজ ঘিরে চাঁদাবাজির ঘটনায় ঘটে গোলাগুলি। এ ঘটনায় গণমাধ্যমে উঠে আসে তার নাম। সময়ের ব্যবধানে তিনি বিশাল সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতাও হয়ে ওঠেন।

 

১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডারসহ মগবাজারের রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ একাধিক খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তার নাম। সে সময় রমনা, মগবাজার, কাওরান বাজার ও মধুবাগে ছিল তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। অভিযোগের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ৩০টির অধিক খুনের মামলা। যার প্রায় সবগুলোতেই সাজাপ্রাপ্ত। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজিসহ প্রায় ১০০ মামলার আসামি তিনি।

 

১৯৯৭ সালে নয়াপল্টনের এক হাসপাতাল থেকে ডিবি পুলিশের এসি আকরাম হোসেন তাকে গ্রেফতার করেন। দেড় বছরের মতো জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু এ সময়েই ঘটে নাটকীয় মোড়। জেলে থাকার ফাঁকে তার স্ত্রী প্রেমে পড়েন তারই দলের এক সদস্যের। সব জেনেও সুব্রত নিজেই স্ত্রীকে সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। ওই ঘরে তার দুই সন্তান ছিল। পরে ১৯৯৯ সালে কুমিল্লার বিউটি নামের এক নারীকে বিয়ে করলেও দাম্পত্য টেকেনি।

 

কয়েক বছরের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। তালিকার এক নম্বরে ছিল সুব্রত বাইনের নাম। তাকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হয়। তখনই তিনি দেশ ছেড়ে কলকাতায় পালিয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জামেলা নামের এক নারীকে বিয়ে করেন সেখানে। সেই ঘরে একটি মেয়ে রয়েছে তার।

 

কলকাতায় বসেই ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। জমি কিনে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করলেও ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশ তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক করে। জামিনে মুক্তি পেয়ে দুবাই পাড়ি জমান। ফিরে এসে চিত্রনায়িকার কাছে চাঁদা দাবি করলে ফের পুলিশের নজরে আসেন।

 

২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স তাকে ধরতে গেলে তিনি নেপালের সীমান্ত শহর কাঁকরভিটায় পালিয়ে যান। সেখানেই নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। প্রথমে ভাদ্রপুর, পরে ঝুমকা কারাগারে নেওয়া হয় তাকে।

 

২০১২ সালে ঝুমকা কারাগারে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে পালিয়ে যান সুব্রত বাইন। কিছুদিন পর কলকাতায় ফিরে এলে পুলিশ তাকে ২৭ নভেম্বর বউবাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। এরপর থেকে কলকাতার জেলেই ছিলেন তিনি। সেখানে ফতেহ আলী ছদ্মনামে আত্মগোপনে ছিলেন। ঢাকায় সুব্রতের পরিবার এক সময় থাকত মগবাজারে। পরে গাজীপুরের পুবাইল হারবাইদ নয়াপাড়ায় পাঁচ কাঠা জমি কিনে বাড়ি বানান তারা। এখনো সেখানেই বাস করেন তার বাবা-মা। পলাতক অবস্থায়ও পরিবারকে ভুলে যাননি সুব্রত।

 

২০০৪ সালে সর্বশেষ মাকে দেখতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। ভারতের কারাগারে বসেও পরিবারের সঙ্গে টুকটাক যোগাযোগ রাখতেন তিনি। আড়াই বছর আগে গোপনে তাকে বাংলাদেশে আনা হয়। এরপর থেকে তিনি ছিলেন গোপন বন্দিশালায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বের হয়ে চলে যান আত্মগোপনে।

 

মোল্লা মাসুদ

সুব্রত বাইনের এক নম্বর শিষ্য। সর্বশেষ গ্রেফতারের শেষ সময় পর্যন্ত গুরুর সান্নিধ্যেই ছিল। নিজ হাতে অন্তত ২৪টি খুন করেছে সুব্রত বাইনের হয়ে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার নাম ছিল ‘কিলিং মেশিন’। সেভেন স্টার গ্রুপের একমাত্র স্ট্রাইকার সে। নাম তার মোল্লা মাসুদ।

 

দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসীর জন্ম ঝালকাঠির মহাদেবপুরে। বাবার নাম আমজাদ হোসেন। থাকতেন ঢাকার রমনার মিরবাগ এলাকায়। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর যখন তৎকালীন সরকার দেশের ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে, তখন ১৩ নম্বরে ছিল তার নাম। তার ছবি ছাপিয়ে টানানো হয় দেশের সব থানায়, এমনকি ইমিগ্রেশন চেকপোস্টেও।

 

বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ইন্টারপোলও জারি করে রেড নোটিশ। মোল্লা মাসুদের অপরাধ জীবনের শুরু কলেজ থেকে। এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে ছাত্রদল, শেষে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেন এবং ভিপি পদের জন্য নির্বাচন করেন। নির্বাচনে হেরে যান মাসুদ।

 

সেই সময়ে এক নেতার দেহরক্ষী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই সময়ই পরিচয় হয় সুব্রত বাইনের সঙ্গে। ধীরে ধীরে ভিন্নরূপে আবির্ভূত হন মাসুদ। একপর্যায়ে খুন হয়ে উঠে মাসুদের নেশা-পেশা। সেভেন স্টার গ্রুপে মাসুদ নামে আরও অনেকে থাকায় তার নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় মোল্লা। তাকে যে কোনো মিশনে পাঠানো হলে ফিরে আসত লাশ নিয়ে।

 

চাঁদার চিঠি নিয়ে গেলেও ফিরে আসত খুন করে। সুব্রত বাইনও জানতেন, মাসুদের কাজ শুধু খুন-এটাই তার একমাত্র দক্ষতা। একবার এমনও ঘটেছে, এক অপারেশনে গুলি ছোড়ার আগে অন্য সদস্য গুলি করে ফেলে। ক্ষুব্ধ হয়ে সেই সাথীকেই গুলি করে বসেন মাসুদ।

 

১৯৯৯ সালে মগবাজারে যুবলীগ নেতা লিয়াকতকে হত্যার জন্য ওতপাতে মাসুদ ও তার সহযোগীরা। লিয়াকতের গাড়ি এলেই এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। গুলিতে কাচ ভাঙে, গুলিবিনিময় হয়, তবে প্রাণে বেঁচে যান লিয়াকত। ক্ষুব্ধ মাসুদ তখন রাগের বশে এক পথচারীকে গুলি করে হত্যা করেন।

 

তার বিরুদ্ধে রয়েছে খিলগাঁওয়ের তিন খুন, মগবাজারের রফিক হত্যা, আদালত চত্বরে আলোচিত মুরগি মিলন হত্যা-সবগুলোতেই সরাসরি অংশগ্রহণ। মুরগি মিলনকে গুলি করে প্রথম আঘাত করে মাসুদই। মগবাজারের এক মার্কেটে ছিল তাদের আস্তানা। সেখান থেকেই ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড পরিচালিত হতো।

 

২০০৪ সালে ক্রসফায়ারের ভয়ে দেশ ছাড়েন মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন। পাড়ি জমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেখানেও থেমে থাকেননি মাসুদ। নতুন নামে পরিচিতি পান রাসেল মাসুদ। মুর্শিদাবাদে ভারতীয় নাগরিক রিজিয়া সুলতানাকে বিয়ে করে গড়েন স্থায়ী ঠিকানা। কিন্তু অপরাধের নেশা ছাড়তে পারেননি।

 

ঢাকার বড় ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় চালিয়ে যান ভারতে বসেই। হুন্ডির মাধ্যমে চাঁদার টাকা পৌঁছে যেত তার হাতে। পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন জাল নোটের ব্যবসায়। পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় অপরাধী চক্রের সঙ্গে গড়ে তোলেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। 

 

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যারাকপুরে বিশেষ অভিযানে তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গোপনে দেশে ফিরে গুরুর আস্তানায় চলে যান মোল্লা মাসুদ।

অপরাধ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর