ঢাকা, ২৫ জুন বুধবার, ২০২৫ || ১১ আষাঢ় ১৪৩২
good-food

সিন্ধু নদ: ইতিহাসের সাক্ষী, জীবনের ধমনী 

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:৪২ ২৪ জুন ২০২৫  

সিন্ধু শুধু একটি নদী নয়, এটি একটি সভ্যতার জন্মদাতা। প্রায় ৩২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী চীনের স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল তিব্বতের মানসরোবরের কাছ থেকে উৎপন্ন হয়ে পাকিস্তানের আরব সাগরে গিয়ে মিশেছে। সিন্ধু নদী যুগে যুগে অঞ্চলের সীমানা গড়েছে। 

 

এই নদীর প্রায় ৮০% পাকিস্তানে প্রবাহিত, যেখানে এটি কৃষিক্ষেত্রের প্রাণ হিসেবে গণ্য হয়; ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে ১৫%, উৎসের গুরুত্ব বহন করে; চীনের তিব্বতে ৫%, যেখানে এই নদীর জন্ম। আফগানিস্তান শাখা নদী কাবুল নদীর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জড়িত। হাজার হাজার বছর ধরে এই নদী এশিয়ার ইতিহাস গড়েছে, সংস্কৃতি লালন করেছে।

 

৫০০০ বছর আগে এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল হরপ্পা ও মোহেনজোদারোর মতো সমৃদ্ধশালী প্রাচীন নগরী। এই সভ্যতা আমাদের শিখিয়েছে শহর পরিকল্পনা আর বাণিজ্যের প্রাচীন রূপ। হরপ্পা সভ্যতায় এটি সাংস্কৃতিক সীমানা তৈরি করেছিল, কোনও রাজ্যের নয়। এই নদী মৌর্য, কুষাণ এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক সীমানা নির্ধারণে সাহায্য করেছিল। 

 

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬-এ আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানে সিন্ধু নদী ছিল মূল খেলোয়াড়। এর উপনদী ঝিলামে রাজা পুরুর সঙ্গে হাইডাসপিসের যুদ্ধে আলেকজান্ডার জয়ী হন। সিন্ধু ছিল তার সেনার সরবরাহ পথ, নৌ-রুট এবং সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমানা। এখানে শহর প্রতিষ্ঠা করে গ্রিক-ভারতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটান।

 

১২২১ সালে সিন্ধুর তীরে চেঙ্গিস খানের সঙ্গে খোয়ারেজমীয় সাম্রাজ্যের শেষ শাসক জালালউদ্দিন মঙ্গকানির মরণপণ লড়াই হয়েছিল। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বাধীন মঙ্গোল সাম্রাজ্য সেই যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল। যুদ্ধে জালালউদ্দিন তার সৈন্যদের সিন্ধু নদীর তীর ও পাহাড়ের কাছে সুবিন্যস্ত করেছিলেন। 

 

কিন্তু চেঙ্গিস খানের স্পেশাল একটি সেনাদের  দল (আমেরিকার নেভী সিল টাইপ) জালালউদ্দিনের সৈন্যদের চোখের আড়ালে অন্য দিক থেকে নদী পার হয়ে, তাদের পাশ কাটিয়ে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে যুদ্ধ জয় নিশ্চিত করে। পরাজয় নিশ্চিত দেখে জালালউদ্দিন ঘোড়ায় চড়ে সিন্ধু নদীতে ঝাঁপ দেন এবং সাঁতরে পালিয়ে যান। চেঙ্গিস খান তার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে গুলি করতে নিষেধ করেন। তবে জালালউদ্দিনের বেশিরভাগ সৈন্য ও পরিবার নিহত হয় এবং খোয়ারেজমীয় সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হয়।

 

সিন্ধু নদীর তীর ধরে আফগান-ব্রিটিশ যুদ্ধে (১৮৩৯-১৯১৯) কখনো আফগানরা, কখনো ব্রিটিশরা জিতেছে। প্রথম যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২) আফগানরা ব্রিটিশদের কাবুল থেকে তাড়ায়। দ্বিতীয় যুদ্ধে (১৮৭৮-৮০) ব্রিটিশরা ক্ষমতা ধরে রাখে। তৃতীয় যুদ্ধে (১৯১৯) আফগানরা স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। সিন্ধু ছিল এই যুদ্ধের নীরব সাক্ষী।

 

যেহেতু এই নদীর কৌশলগত ভূমিকা ব্রিটিশ রাজের জন্য অপরিহার্য ছিল, যেখানে ব্রিটিশদের নৌ ঘাঁটি ছিল, তাই তারা ১৮৯৩ সালে সিন্ধু নদীর পশ্চিমে পশতুন অঞ্চল ডুরান্ড লাইন বরাবর ভাগ করে নদীটি নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে ১৯১৯-এ আফগানরা যখন স্বাধীনতা পায় তারা নদীটি হারিয়ে ফেলে। আফগানরা সিন্ধুর কাছাকাছি পেশোয়ার দাবি করলেও ব্রিটিশরা ছাড়েনি। ১৯৪৭ এ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলে নদীটির সিংহভাগ পাকিস্তান অঞ্চলে পড়ে। 

 

২০০১-২০২১ সালের আমেরিকান-আফগান যুদ্ধে সিন্ধু নদী সরাসরি ভূমিকা না পালন করলেও এর উপনদী কাবুল নদী এবং পাকিস্তানের সিন্ধু অববাহিকা ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পেশোয়ারের কাছে তালিবানের আশ্রয়স্থল, মার্কিন সরবরাহ রুটের জন্য সিন্ধু ছিল অপরিহার্য। 

 

বর্তমানে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধুর পানি নিয়ে চুক্তি থাকলেও কাশ্মীর ও সীমান্ত বিরোধ এই নদীকে ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রে রেখেছে। ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি (IWT) ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে কাশ্মীরের পাহালগামে ২৬ জনের মৃত্যুর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত চুক্তিটি স্থগিত করে। 

 

পাকিস্তান এটিকে “যুদ্ধের কাজ” বলে আইনি পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। ভারত পানির প্রবাহ কমানোর পরিকল্পনা করছে, যা পাকিস্তানের ৮০% কৃষির জন্য হুমকি। তবে ভারতের এখনই পানি বন্ধ করার অবকাঠামো নেই। এই উত্তেজনা কাশ্মীর বিরোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের চাপে আরও জটিল হয়েছে।


সিন্ধু শুধু নদী নয়, এটি জীবন, ইতিহাস আর সংগ্রামের প্রতীক।

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর