ঢাকা, ৩০ মে শুক্রবার, ২০২৫ || ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
good-food
২৭

সেনাপ্রধানের বক্তব্য:রাজনীতিতে তোলপাড়, বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:৪৩ ২৮ মে ২০২৫  

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সেনাপ্রধানের যে বক্তব্য ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গত কয়েক দিন ধরে তোলপাড় চলছে, তার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সেনাবাহিনী। সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, “সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে প্রকাশিত বিষয়গুলোর বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে।”

 

‘সেনাবাহিনীর কার্যক্রম’ নিয়ে সোমবার ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার এই সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমার, আরকান আর্মি, রাখাইন করিডোর, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।

 

কর্নেল শফিকুল ইসলাম ছাড়াও সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন। দুই কর্মকর্তাই বলেন, দেশের ‘নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়’ এমন কোনো কাজে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না।

 

কী বলেছিলেন সেনাপ্রধান

গত ২১ মে ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যে বক্তব্য দেন, সেখানে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন ছাড়াও করিডোর, বন্দর, সংস্কারের মতো বিষয় উঠে আসে বলে দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।

 

ওই অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা আমন্ত্রিত ছিলেন না। সেনা সদর বা আইএসপিআর সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে কোনো বিবৃতি বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও দেয়নি। সংবাদপত্রগুলো সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বরাতে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।

 

সংবাদপত্রে সেনাপ্রধানকে উদ্ধৃত করে আসা বিষয়গুলো মোটাদাগে এরকম–

>> ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত’ বলে জেনারেল ওয়াকার অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন।

>> তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে।

 

>> চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়া নিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত; এখানে স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের মতামত প্রয়োজন হবে।

 

>> সংস্কার প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা আলোচনা করা হয়নি।

 

>> সেনাপ্রধান বলেন, জুলাই-অগাস্টের ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন সম্পর্কে সেনাবাহিনী কিছুই জানত না। এ বিষয়ে জাতিসংঘকে সেনাবাহিনী জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, সরকারকে জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করেনি।

 

>> অনুষ্ঠানে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ‘মব ভায়োলেন্সের’ বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেন। তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ জনতার নামে বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা ‘আর সহ্য করা হবে না’।

 

নানা রকম আন্দোলনে অস্থির অবস্থায় থাকা রাজনৈতিক অঙ্গনে সেনাপ্রধানের ওইসব বক্তব্য নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। বিশেষ করে নির্বাচন, বন্দর ও করিডোর নিয়ে সরকারের অবস্থানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

এরপর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘পদত্যাগের অভিপ্রায় জানিয়েছেন’ বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। শনি ও রোববার দুই ডজন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন। সবগুলো দলই ইউনূস সরকারের প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়ে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে নিজেদের দাবিগুলো তুলে ধরে। 

 

সেনাসদর কী বলছে?

‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য নিয়ে সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন সাংবাদিক।

 

জবাবে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, “সেনাপ্রধান যেকোন সময় বা সময়ে সময়ে অফিসার বা সৈনিকদের সাথে কথা বলে থাকেন, দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এটি তারই একটি ধারাবাহিকতা মাত্র। “এখানে আমরা কোনো সাংবাদিককে ডাকিনি, তিনি জাতির উদ্দেশে কোনো ভাষণ দেননি, আইএসপিআর সরকারিভাবে কোনো বিবৃতি দেয়নি।”

 

এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, "যেটা গণমাধ্যমে বা সোশাল মিডিয়াতে দেখছেন, এটার সঠিকতা বা বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে।" আরেক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শফিকুল বলেন, “এটার সঠিকতা নিয়ে আমরা যথেষ্ট সন্দিহান। আমরা যদি কোনো কিছু জানাতেই চাইতাম, তাহলে আপনাদের ডাকতাম, গণমাধ্যম থাকত, আইএসপিআর বিবৃতি দিত। এসবের কিছুই করিনি।"

 

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "নির্বাচন নিয়ে (‘অফিসার্স অ্যাড্রেসে’) অনেক কথা হয়েছে, এ বিষয়ে আমরা কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। তবে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। আমাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।"

 

দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা বা নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী ‘একতাবদ্ধ হয়ে’ কাজ করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এ সেনা কর্মকর্তা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে মতপার্থক্যের যে গুঞ্জন, সে বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, "এরকম আসলে কিছু হয়নি। বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনী ওতোপ্রতভাবে কাজ করছে। একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করছে। একটি পরিবারের মত।"

 

করিডোর, পাহাড় ও মিয়ানমার প্রসঙ্গ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য বাংলাদেশ সীমান্তে ‘মানবিক করিডর’ করার যে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে, সে বিষয়েও প্রশ্ন করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। কর্নেল শফিকুল জবাবে বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোনো বিষয়ে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না।”

 

পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "পাহাড়ে একটি আত্মস্বীকৃত টেরোরিস্ট দল রয়েছে, যারা সংঘাতপূর্ণ কাজ করে থাকে। তাদেরকে নির্বাচনে যুক্ত করা সমীচীন নয় বলে মনে হয়।"

 

চট্টগ্রামে কুকি চিনের পোশাক তৈরি হচ্ছে, পুলিশ ৩০ হাজার পোশাক উদ্ধার করেছে, এসব বিষযেও প্রশ্ন আসেও সংবাদ সম্মেলনে। কর্নেল শফিকুল বলেন, "কুকি চিন বম সম্প্রদায়ের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের টোটাল সংখ্যা হচ্ছে ১২ হাজার জন। এই ১২ হাজার জন কীভাবে ৩০ হাজার ইউনিফর্মের জন্য…।”

 

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, “এই সংবাদটি বস্তুনিষ্ঠ। কেএমএফের অস্ত্রের ব্যবহার দেখেছি আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে। আমাদের সেনা সদস্য আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু বরণ করেছে তাদের দ্বারা। সেই প্রেক্ষাপটে এটা ভালো খবর নয়।

 

“এটা নিরাপত্তার সাথে জড়িত হওয়ায় আমলে নেওয়া হয়েছে, কাদের জন্য এটা তৈরি হচ্ছিল এবং এই ত্রিশ হাজার পোশাক তাদেরই কিনা সেটা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

 

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পথে অস্ত্র আনা-নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজিম বলেন, “বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার একটি জটিল পরিস্থিতির মুখে আছে এখন। ওই জায়গায় মিয়ানমার সরকারের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। রাখাইন অলমোস্ট দখল হয়ে গেছে।

 

“৮৫ থেকে ৯০ ভাগ দখল হয়ে গেছে। আরাকান আর্মি একটা অথরাইজ সংগঠন নয়। এই জায়গায় না আছে সরকারের অস্তিত্ব সেভাবে, না আছে আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দেওয়ার মত একটা অবস্থা। এক্ষেত্রে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সীমান্ত অবস্থা যে কোনো সময়ের তুলনায় সংবেদনশীল।”

 

তিনি বলেন, “এই সময় আর্মড গ্রুপের মুভমেন্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার মানে এই নয় যে এটাকে আমরা স্বীকৃতি দেব বা দেখেও না দেখার মত পদক্ষেপ গ্রহণ করব না। আমরা সার্বক্ষণিক নজরদারি করছি।" সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের রাখতে যৌথ অভিযানকালে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়।

রাজনীতি বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর