ঢাকা, ১৯ ডিসেম্বর শুক্রবার, ২০২৫ || ৫ পৌষ ১৪৩২
good-food

নিয়ম মেনে চলার পরও ওজন কমছে না? জেনে নিন সমাধান

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৮:৩৯ ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫  

আপনি প্রতিদিন নিয়ম করে স্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন। তেল চর্বি বাদ দিয়ে একেবারে ক্লিন ডায়েট মেনে চলছেন। এমনকি জিমে গিয়ে ঘামও ঝরাচ্ছেন। জীবনধারা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছেন। তবে এত কিছুর পরেও ওজন কমছে না! অনেকেই এমন সমস্যায় পড়েন। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি আছে। তবে আমেরিকার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আপনি হয়তো সব ঠিকই করছেন কিন্তু আপনার শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা একটি বিশেষ সমস্যার কারণে ওজন কমছে না।

ডাঃ জনি হাদাক নামের একজন ফ্যামিলি মেডিসিন ও লাইফস্টাইল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন। সেখানে তিনি এই সমস্যার মূল কারণ এবং এর সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি জানান, যারা ক্যালোরি মেপে খাবার খেয়ে এবং প্রচুর ব্যায়াম করেও ওজন কমাতে পারছেন না তারা সম্ভবত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স নামের একটি সমস্যায় ভুগছেন। আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত এবং অজান্তেই ওজনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।

ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স আসলে কী?

ইনসুলিন হলো আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা বা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যখন খাবার খাই তখন রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করা প্রবেশ করে। ইনসুলিন সেই গ্লুকোজকে শরীরের কোষগুলোতে পৌঁছে দেয় যাতে কোষগুলো শক্তি পায়। কিন্তু ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হলে শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের ডাকে ঠিকমতো সাড়া দেয় না। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় এবং শরীর সেই বাড়তি শর্করাকে চর্বি হিসেবে জমা করতে শুরু করে। এটি ভবিষ্যতে টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। তাই অল্প খাবার খেলেও ওজন না কমার পেছনে এই কারণ থাকতে পারে। কারণ ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ না করলে শরীর চর্বি পোড়াতে পারে না। ফলে ব্যায়াম বা ডায়েটের প্রভাব কমে যায়।

কার্বোহাইড্রেট ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সম্পর্ক

ডাঃ হাদাকের মতে, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের অন্যতম প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ। তিনি বলেন প্রতিবার কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে ইনসুলিনের মাত্রাও বেড়ে যায়। একজন সাধারণ মানুষ দিনে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করেন যা শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।

তিনি আরও বলেন, কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন উভয়েরই প্রতি গ্রামে ক্যালোরির পরিমাণ সমান। অর্থাৎ ১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেটে ৪ ক্যালোরি এবং ১ গ্রাম প্রোটিনেও ৪ ক্যালোরি থাকে। কিন্তু পার্থক্য হলো এদের কাজ করার পদ্ধতিতে। আপনি যদি ৩০০ গ্রাম প্রোটিন খান তবে আপনার পেট এতটাই ভরা থাকবে যে আপনি নড়াচড়াও করতে চাইবেন না। কিন্তু সমপরিমাণ কার্বোহাইড্রেট খেলে কিছুক্ষণ পরেই আবার ক্ষুধা লাগবে। প্রোটিন শরীরে জিএলপি নামের একটি হরমোনের মাত্রা বাড়ায় যা দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে এবং বারবার খাওয়ার ইচ্ছা বা ক্রেভিং কমায়।

অনেকেই ভাবেন বেশি প্রোটিন খেলেও ওজন বাড়বে। কিন্তু চিকিৎসকের মতে তা ঠিক নয়। বরং তিনবেলা খাবারে পর্যাপ্ত প্রোটিন নিলে ওজন নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।

সমস্যা সমাধানে করণীয়

ওজন কমানোর চাবিকাঠি হলো ইনসুলিনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এর জন্য ডাঃ হাদাক তিনটি সহজ কিন্তু কার্যকরী পরামর্শ দিয়েছেন।

প্রতি বেলার খাবারে প্রোটিন নিশ্চিত করুন

কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কমিয়ে প্রোটিন খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিন। দিনে তিন বেলা খাবার খেতে হবে এবং প্রতি বেলার খাবারে ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম প্রোটিন থাকতে হবে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে বেশি প্রোটিন এবং ফাইবারযুক্ত খাবার খেয়েছেন তাদের ওজন কমানোর হার সবচেয়ে বেশি। মাছ মাংস ডিম ডাল বা পনির হতে পারে প্রোটিনের ভালো উৎস।

ফাস্টিং বা উপবাস

ইনসুলিনের মাত্রা কমানোর জন্য ফাস্টিং বা উপবাস একটি দারুণ উপায়। আপনি যদি সকালে উঠেই কফিতে ক্রিম মিশিয়ে খান এবং সারা দিন ধরে এটা ওটা খেতেই থাকেন তবে আপনার রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা সবসময় বেশি থাকবে। এমনকি রাতে ঘুমানোর আগেও যদি মিষ্টি কিছু খান তবে শরীর কখনোই চর্বি পোড়ানোর সুযোগ পাবে না।

ডাঃ হাদাক দিনে ১৪ ঘণ্টা ফাস্টিং বা না খেয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে ফেলুন এবং পরদিন সকাল ৯টায় নাস্তা করুন। এই ১৪ ঘণ্টা সময়ে শুধু পানি ব্ল্যাক কফি বা গ্রিন টি পান করতে পারেন।

তবে নারীদের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নারীদের মাসিক চক্রের ফলিকুলার ফেজ বা শুরুর দিকে ফাস্টিং করা নিরাপদ কিন্তু লুটিয়াল ফেজ বা শেষের দিকে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা উচিত নয়।

শরীরকে সচল রাখুন

ব্যায়াম বা শারীরিক নড়াচড়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে শুধু ক্যালোরি পোড়ানোর জন্য নয় বরং পেশি বা মাসল বাড়ানোর জন্য ব্যায়াম করা উচিত। ডাঃ হাদাক বলেন, পেশি হলো একটি সক্রিয় অঙ্গ। আপনার শরীরে যত বেশি পেশি থাকবে আপনার মেটাবলিজম বা বিপাক হার তত ভালো হবে। আমরা যখন নড়াচড়া করি তখন পেশিগুলো রক্ত থেকে শর্করা শুষে নিয়ে শক্তি উৎপাদন করে। এতে রক্তের সুগার কমে এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স দূর হয়।

তিনি প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন। হাঁটা সাইক্লিং বা ওয়েট লিফটিং যেকোনো কিছুই হতে পারে। মূল কথা হলো শরীরকে অলস বসে থাকতে দেওয়া যাবে না।

ওজন কমাতে কী করবেন?

চিকিৎসকের মতে কয়েকটি সহজ নিয়ম মেনে চললে শরীর ভালো থাকতে পারে।

  • প্রোটিন বেশি খেতে হবে। প্রতিদিন তিনবেলা খাবারে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ গ্রাম প্রোটিন নেয়া যায়।
  • কার্বোহাইড্রেট কমাতে হবে। রুটি ভাত পাস্তা রুটি বিস্কুট চিনি এসব সীমিত করতে হবে।
  • প্রতিদিন কিছু সময় না খেয়ে থাকতে হবে। এতে ইনসুলিন কমবে এবং শরীর ফ্যাট পোড়াবে।
  • শরীরচর্চা করতে হবে। এতে রক্তে শর্করা কমে এবং শরীর শক্তিশালী হয়।

সতর্কতা

যদিও এই নিয়মগুলো অনেকের কাজে দেয়, তবু সবার শরীর একরকম নয়। কারও কোনো রোগ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়াবেটিস হরমোন সমস্যা বা ওষুধ খেলে আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি।

অনেকেই মনে করেন ক্যালোরি কমালেই ওজন কমে যাবে। কিন্তু শরীরের ভেতর যে প্রক্রিয়া কাজ করে তা আরও জটিল। ইনসুলিন রেজিসট্যান্সের মতো সমস্যা থাকলে শুধু ডায়েট ব্যায়াম বা জল খেয়েই লাভ হয় না। তাই খাবারের ধরন ও অভ্যাস বদলাতে হয়। প্রোটিন বাড়ানো কার্বোহাইড্রেট কমানো দৈনিক নড়াচড়া ও নির্দিষ্ট সময় খাবার থেকে বিরতি রাখলে শরীর পরিবর্তন শুরু করতে পারে। ওজন কমা সহজ মনে হতে পারে। তবে এর জন্য ধৈর্য ও পরিকল্পনা প্রয়োজন।

নিজের শরীর বোঝা এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়াই সবচেয়ে নিরাপদ পথ। এতে ওজন কমলে শরীরও সুস্থ থাকে। আপনি যদি এমন সমস্যায় থাকেন তবে সচেতনভাবে জীবনযাপন বদলালে উপকার পেতে পারেন।