ঢাকা, ১৯ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১২৭৪

সেই নারীর জন্যই আমরা বেঁচে গেছি: মুমিনুল

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০৮:৫৬ ১৭ মার্চ ২০১৯  

দেশে ফেরার বিমানে ওঠার আগে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন মুমিনুল হক।  চীনের বার্তা সংস্থা সিনহুয়া তার সাক্ষাতকার প্রকাশ করেছে।

মুমিনুল বলেন, ‘সেই নারীর জন্যই আমরা বেচে গেছি।’

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলার ভয়ঙ্কর স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে দেশের পথ ধরেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারররা।

 তাদের এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ভয়-আতঙ্ক। সেই ভয়ের আরেক পাশে আছে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পরম স্বস্তিও। আছে কৃতজ্ঞতা বোধ।

মূল কৃতজ্ঞতাটা অবশ্যই মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি। আল্লাহর আশির্বাদেই প্রাণ নিয়ে ফিরে পেরেছে বাংলাদেশ দলের সদস্যরা।

তবে, সৃষ্টিকর্তার সেই প্রাণ বাঁচানোর আশির্বাদটা প্রতিফলিত হয়েছে দু’ভাবে। প্রথমত, বাংলাদেশ দল হামলার স্থল ক্রাইস্টচার্চের মসজিদ আল-নূরে পৌঁছায় মিনিট দশেক দেরি করে। দ্বিতীয়ত, তাদের মসজিদের ভেতরে যেতে মানা করেন এক নারী। তিনি গাড়ির ভেতর থেকে বারণ না করলে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা হয়তো হুড়মুড় করে মসজিদে ঢুকেই পড়ত। আর সেক্ষেত্রে কি ঘটতে পারত, সে কথা ভাবলেই গা শিউরে উঠছে।

গত শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চের দুটো মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন ৪৯ জন। আহত হয়েছেন ৪৮ জন। 

ওই দুই মসজিদের একটি, মসজিদ আল-নূরে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ভাগ্য ভালো, তারা মসজিদে পৌঁছানোর কয়েক মিনিট আগেই ওই সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশ দল মসজিদে পৌঁছানোর কথা ছিল নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় সময় বেলা ১টা ৩০ মিনিটে। কিন্তু, ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে কিছু দেরি করে ফেলায় বাংলাদেশ দল মসজিদে পৌঁছায় নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পরে। মানে ১টা ৪০ মিনিটে।

তাতেই প্রথম রক্ষাটা হয়েছে। কারণ, আর মিনিট পাঁচেক আগে গেলেও হামলার সময় বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা মসজিদের ভেতরেই থাকতেন।

বিপদ ঘটতে পারত তখন। কারণ, বাংলাদেশ দলের বাস মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছানোর সময়ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী নির্বিচারে গুলি করে যাচ্ছিলেন। ফলে গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢুকলে বিপদই ঘটে যেতে পারত। তবে, মহান আল্লাহা তা’য়ালার আশির্বাদে সেটা হয়নি। এ যাত্রায় আল্লাহর দূত হয়ে আসেন এক নারী। বাংলাদেশ দল পৌঁছানোর সময় মসজিদের ভেতর থেকে রক্তমাখা শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি।

তখনো তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা বুঝে উঠতে পারেননি মসজিদের ভেতরে কি নারকীয় তাণ্ডব চলছে! তারা তাই মসজিদে ঢুকতেই যাচ্ছিল। ঠিক তখনই পাশের এক গাড়ি থেকে এক নারী তাদের মসজিদে ঢুকতে বারণ করেন। বলেন, ‘ভেতরে গুলি হচ্ছে। আমার গাড়িতেও গুলি লেগেছে। তোমরা ভেতরে ঢুকো না।’

এরপরই বাংলাদেশ দল আঁচ করতে পারে ঘটনার ভয়াবহতা। সঙ্গে সঙ্গেই তারা গাড়ির ভেতরে ঢুকে অবরুদ্ধ অবস্থায় বসে থাকে। গাড়ির জানালা খুলে দেখতে পায়, মসজিদের ভেতর থেকে একের পর এক মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসছেন আর আচড়ে পড়ছেন ফ্লোরে। দৃশ্য দেখে ভয়ে-আতঙ্কে কাঁদতে থাকেন ক্রিকেটাররা।

ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে মুমিনুল বলেছেন, ‘আমরা মধ্যাহ্নভোজ সেরে বের হয়েছিলাম। অনুশীলন ছিল বেলা ২টায়। মসজিদে যাওয়ার কথা ছিল দেড়টায়। রিয়াদ (মাহমুদউল্লাহ) ভাইয়ের সংবাদ সম্মেলনের জন্য একটু দেরি হয়ে যায়। মিনিট দশেক পরে বের হয়েছি আমরা। ফোন নিয়ে ব্যস্ত এক নারী মসজিদ থেকে বের হয়ে এসে আমাদের যেতে নিষেধ করেন। তখনো আমরা কিছু বুঝিনি। পরে গাড়ি থেকে আরেক নারী চিৎকার করে একই কথা বললেন, ‘তোমরা ভেতরে যেও না। কে যেন গুলি করছে। আমার গাড়িতেও গুলি লেগেছে। তখনই আমরা বুঝতে পারি পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর।’

একটু দম নিয়ে তিনি বলে যান, আমরা গাড়ির ভেতরে পাঁচ-দশ মিনিটের মতো বসেছিলাম। পাইলট ভাই (খালেদ মাসুদ) ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। পেছন থেকে তামিম ভাই এলেন। আমরা ড্রাইভারকে জানালা খুলতে বলি। দেখলাম অনেকগুলো লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। আমরা বাসের পেছনের দরজা খুলে পার্কের মধ্যদিয়ে হেঁটে চলে আসি।

মুমিনুল বলেন, পাঁচ মিনিট আগেও যদি পৌঁছাতাম, তাহলে আমরা মসজিদের ভেতরেই থাকতাম এবং সবাই শেষ হয়ে যেতাম। আল্লাহর অশেষ রহমত যে, আমরা পাঁচ মিনিট দেরিতে পৌঁছেছি। আমরা মসজিদে গেলে পেছনের দিকেই বসতাম এবং সে আমাদের কাউকে জীবিত রাখত না। কারণ, সে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। কোনো বাছবিচার করেনি। আমরা এতোটাই ভয় পেয়েছি যে, বাসের মধ্যেই কেঁদেছি।

আমরা ভয়েই কেঁদেছি। আমরা আসলে বেঁচে গেছি গাড়ির ভেতরের ওই নারীর জন্য, যিনি আমাদের মসজিদের ভেতরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। প্রথম নারী বলার পর আমরা মনে করেছিলাম, তিনি বুঝি অসুস্থ। কারণ, নিউজিল্যান্ডে এমন কিছু ঘটতে পারে, বিশ্বাসই করতে পারিনি। কিন্তু, ওই নারী গাড়ি থেকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, তার গাড়িতেও গুলি লেগেছে। তখনই আমরা পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা আঁচ করতে পারি।

কাতর কণ্ঠে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে  মুমিনুল জানান, মসজিদে যাওয়ার আগে রিয়াদ ভাই জানতে চেয়েছিলেন, নামায পড়ে খাব নাকি খেয়ে নাজায পড়তে যাব? আমরা সিদ্ধান্ত নিই, অনুশীলন যেহেতু জুমার নামাযের পর ২টায়, তাই নামায পড়ে এসেই খাব। কিন্তু, পরে কোনো এক কারণে সিদ্ধান্তটা পাল্টে যায়। আমরা খেয়েই নামায পড়তে যাই। হয়তো এ কারণেই বেঁচে গেছি। আমরা কি পরিমাণ ভয়ে ছিলাম, বলে বোঝানো যাবে না। নিজ চোখে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা দেখলে কেমন লাগে, কল্পনাও করতে পারবেন না।

সাক্ষাৎকার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর