ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১০৬৫

করোনা: কেমন আছেন ক্যামেরার নেপথ্যের মানুষেরা?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৬:০৫ ৩ অক্টোবর ২০২০  

কয়েক দশক আগেও বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে ছবি তোলা ছিল বিশেষ উৎসব। রীতিমতো আয়োজন করে প্রস্তুতি নিয়ে পরিবার-পরিজন সমেত স্টুডিওর বিশেষ কক্ষে বিশেষভাবে ধারণ করা হতো সেসব ছবি। কালের বিবর্তনে ক্যামেরায় পরিবর্তন এসেছে। 

 

রিলের ক্যামেরার পরবর্তী ধাপে এসেছে ডিজিটাল ক্যামেরা। যেখানে রিলের পরিবর্তে জায়গা দখল করে নিয়েছে মেমোরি কার্ড। সেই মেমোরি কার্ডেও এসেছে আধুনিকায়ন। শত শত ছবির পরিবর্তে এখন ধারণ করা যায় হাজারে হাজার ছবি। 

 

এরও উন্নত সংস্করণ হিসেবে আধুনিক ক্যামেরার রূপান্তর ঘটেছে স্মার্টফোনে। ক্যামেরা এসেছে হাতের মুঠোয়। এ কামেরা দিয়ে শুধু স্থিরচিত্র নয়, এমনকি চলচ্চিত্রও ধারণ করা সম্ভব। তবুও বিশেষ দিন, বিশেষ উৎসবে, বিশেষভাবে ক্যামেরায় ছবি তোলার আয়োজন করা হয়। যা আগে ছিল বাঙালির বিশেষ বিলাসিতা। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ছবি তোলার বিষয় ছিল, যা বর্তমানে ব্যাপকতা লাভ করেছে।

 

অতীতের সীমিত পরিসরের আলোকচিত্রীদের ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন, এসেছে ব্যাপকতা। পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রেও হয়েছে বিশেষায়ণ। স্বভাবতই আধুনিক পেশাদার ক্যামেরার যুগে আলোকচিত্রও (ফটোগ্রাফি) জায়গা করে নিয়েছে যেকোনও উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে। 
বর্তমান তরুণদের একটি অংশের জীবন ও জীবিকা গড়ে উঠেছে একে কেন্দ্র করে।  করোনাকালে এদের বড় অংশ জীবিকা হারিয়েছেন। আবার কেউ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কাজ করছেন সীমিত পরিসরে।

 

সালেহ আহমেদ (৫২), ৯০’র দশক থেকে একাধারে পেশাদার ফটোগ্রাফার। পাশাপাশি ১৯৯৮ সালে নীলক্ষেতে ‘স্টুডিও ভিশন’ – নামে স্টুডিও ব্যবসা শুরু করেন তিনি। শুরুর দিকে স্টুডিওর পরিসর যেমন ছিল বিস্তৃত, তেমনি স্টুডিও সংশ্লিষ্ট ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রও ছিল ব্যাপক। আগে প্রতিদিন একাধিক পরিবার স্টুডিওতে আসতেন পারিবারিক ছবি তুলতে। এছাড়া প্রচুর অনুষ্ঠানের ছবি তোলার অর্ডার থাকতো। 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, উদয়ন বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের ছবি তোলা ছিল প্রধান কাজ। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের বিশেষ অনুষ্ঠানের ছবি তোলার কাজটিও ছিল নিয়মিত। সেসব ছবি ল্যাব থেকে প্রিন্ট করানোর কাজটিও ছিল অন্যতম। এ ছবির মান ভালো হওয়া সত্ত্বেও তুলনামূলক খরচ বেশি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহক কম্পিউটার প্রিন্টেড ছবিকে প্রাধান্য দেন। 

 

পরবর্তীতে সময়ের পরিক্রমায় সবার হাতে হাতে অত্যাধুনিক স্মার্টফোনের ক্যামেরা হয়ে উঠেছে সেসব অনুষ্ঠানের ছবি তোলা ও সংরক্ষণের মূখ্য মাধ্যম। ফলে কাজের ক্ষেত্র অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়ে। তবুও মোটামুটিভাবে চলছিল ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত অফিসিয়াল ছবি তোলা ও প্রিন্টের কাজ। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের ভিসা আবেদন এবং পাসপোর্টের জন্য ছবি।

 

কিন্তু করোনা মহামারিতে সামগ্রিকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে এ ব্যবসা। সালেহ আহমেদ বলেন, আগে স্টুডিওতে কাজ করতাম চারজন, আর বর্তমানে কষ্টেসৃষ্টে মাত্র দু’জন। ভাইরাসের শুরুতে সরকারি আদেশে দু’মাস স্টুডিও পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এরপরে খুললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাতে একেবারেই কাজ নেই। কোনোমতে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আগে যেখানে দৈনিক আট থেকে ১০ হাজার টাকার ব্যবসা হতো এখন দুই হাজার হওয়াই কষ্টসাধ্য।

 

নীরব (ছদ্মনাম) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠানের হয়ে খণ্ডকালীন আলোকচিত্রীর কাজ করতেন। করোনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়, কাজও বন্ধ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে ঢাকায় বাসা ভাড়া বহন করা হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। অগত্যা, জুনের শুরুতে বাধ্য হয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান।

 

মোহাম্মদ কবির একমাত্র ছেলের চতুর্থ জন্মদিন পালন করলেন। এ বছর ইচ্ছে ছিল জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। ফটোগ্রাফারকে বলেও রেখেছিলেন। পরবর্তীতে করোনা সংক্রমণের কারণে সবকিছু বিবেচনা করে, বিশেষত পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা বিবেচনায় রেখে সীমিত পরিসরে ঘরোয়া অনুষ্ঠানেই পালন করেন ছেলের জন্মদিন। স্বভাবতই পেশাদার ফটোগ্রাফি সংক্রান্ত আয়োজনটি বাতিল করতে হয়। শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্মার্টফোনই ছিল ভরসা।

 

এ বিষয়ে স্পেকট্রা ইমিটেশনের জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী রিফাত বিন আহসান বলেন, করোনার প্রথমদিকে মূলতঃ ঘরে বসে কাজ করেছি। প্রোডাক্ট শুট বা এ ধরনের ছোটোখাটো কাজ হয়েছে। বিয়ে বা এ ধরনের অনুষ্ঠানের কাজ পুরোপুরি বন্ধ। অনেকেই বর্তমানে অনলাইন ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। ফলে প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফির সুযোগ মিলছে। খাবার-দাবার, মশলা, ক্র্যাফটিং, গিফট আইটেম, এসব পণ্যের কাজই বেশি আসছে এ সময়ে।’

 

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্পর্কে রিফাত বলেন, এটি অল্প সময়ে সম্ভব হবে না। মোটামুটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক ধাক্কা যাচ্ছে সবার উপর দিয়ে। সম্ভাব্য ক্লায়েন্টের বাজেটও এখন কম। তবে, দীর্ঘ সময় লেগে থাকলে একটা ইমেজ তৈরি হয়, যেটা ভবিষ্যতে কাজে দেবে।

 

ফটোগ্রাফি শিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে স্পেকট্রা ইমিটেশনের কর্ণধার ও প্রধান আলোকচিত্রী নাভিদ ফারহান বলেন, এ মুহূর্তে আলোকচিত্র শিল্প অন্যান্য শিল্পের মতোই মোটামুটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। অনেকের পাওনা টাকা আটকে গেছে। অনেকের অ্যাডভান্স বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। বড় কোম্পানিগুলো কমার্শিয়াল কাজের বাজেট কমিয়ে দিচ্ছে। এতে কাজের মানের উপরেও যথেষ্ট প্রভাব পড়ছে। যারা ডেডিকেটেড তারা এখনো লেগে আছেন। একটা সময়ে সবকিছু স্বাভাবিক হবে এ আশায় চর্চাটা ধরে রাখছেন।

 

আলোকচিত্র, স্থিরচিত্র, ফটোগ্রাফ কিংবা ছবি, যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা হচ্ছে সময়ের আয়না। কখনো ইতিহাসের সাক্ষী, কখনো বা অতীতের প্রতিচ্ছবি। সময়কে ধরে রাখার এ শিল্প করোনার কঠিন সময় কাটিয়ে ক্যামেরার ক্লিক-ক্লিক শব্দে এবং চোখধাঁধানো আলোর ঝলকানিতে আবার তুমুলভাবে মূখর হয়ে উঠবে- এ প্রত্যাশাতে আছেন সংশ্লিষ্ট সবাই।