ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৮৫১

নায়ক - নায়িকারা আসলেই রুপালী জগতের বাসিন্দা!

স্বপন ধর

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:০৭ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

আমাদের শৈশব থেকে তরুণ বয়স, এই সময়টুকুকে সিনেমার স্বর্ণযুগ বলা চলে। তখন এমনিতেই মানুষ হলমুখী ছিলো। মানুষ সপরিবারে সিনেমা দেখতে যেতো। শৈশবে বাবা-মা সহ আমি বেশ কিছু ছবি দেখেছিলাম। তখন থেকেই সিনেমার প্রেমে পড়ে যাই।


রিকসায় করে পোস্টার সহযোগে মাইকিং চলতো এইরকম - "হ্যাঁ ভাই, কাজী জহির পরিচালিত, বিউটি কুইন শাবানা আর নায়করাজ রাজ্জাক অভিনিত, নিটোল প্রেমের ছবি  'অবুঝ মন' চলছে আপনাদেরই প্রিয় প্রেক্ষগৃহ নিরালা'য়।" 


দেয়ালে দেয়ালে সাটানো থাকতো সিনেমার পোস্টার। আমার কাছে তখন মনে হতো নায়ক - নায়িকারা আসলেই রুপালী জগতের বাসিন্দা। 


তখন কিছু কিছু নায়ক নায়িকার নামের আগে একটা করে টাইটেলও থাকতো, যেমন : নায়করাজ রাজ্জাক, ড্যাসিং সোহেল রানা, ম্যাগাস্টার উজ্জ্বল, বিউটি কুইন শাবানা, মিষ্টি মেয়ে কবরী, ড্রিম গার্ল ববিতা, সুইট সুচরিতা ইত্যাদি ইত্যাদি।


তখন রেডিওতে সিনেমার প্রোমোশনের জন্য পনেরো মিনিটের একটা বিজ্ঞাপন প্রচার হতো, মনে হয় দুপুর দেড়টা অথবা দুটোর দিকে। উপস্থাপনা করতেন নাজমুল হুসাইন এবং গাজী মাজহারুল ইসলাম। এদের দরাজ কন্ঠে এক ধরণের মাদকতা ছিল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম রেডিওতে ওগুলো শোনার জন্য।


যশোর শহরে প্রথম দিকে ছিলো তিনটি হল : নিরালা, তসবীর মহল আর চিত্রা। যশোর ক্যান্টনমেন্টে ছিলো গ্যারিসন হল, সেখানে মাঝে মাঝে ভারতীয় বাংলা এবং হিন্দী ছবিও চলতো। এরপর আর একটা হল হয়, তার নাম মানসী। তবে সব থেকে সাড়া ফেলেছিল যে হল, তার নাম মনিহার। তখনকার সবথেকে বড় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বেশী আসন সংখ্যার অত্যাধুনিক সিনেমা হল।


তখন কোন কোন ছবি বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতো। খুব কম ছবিই ছিলো যেটা দুই সপ্তাহের কম চলতো, যদি না সেটা পুরোন ছবি না হতো। কোন কোন ছবি তো সিলভার জুবিলি, গোল্ডেন জুবিলি, প্লাটিনাম জুবিলি বা ডায়ামন্ড জুবিলিও চলতো। 


তার মানে শহরের সব মানুষ তো দখতোই, পাশাপাশি হিট ছবিগুলো দেখার জন্য আশেপাশের গ্রাম থেকেও দর্শকেরা তখন দলে দলে আসতো সিনেমা দেখত এবং তখন এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল যে দর্শকেরা একই ছবি একাধিকবার দেখছে।


আমি শৈশব থেকে বাবা কিংবা কাকার সাথে বাজারে যেতাম। এভাবে সঙ্গ দিতে দিতে বাজার কিভাবে করতে হয়, তা অল্পদিনেই শিখে গেলাম। এই যে অল্পদিনে একা একা বাজার করা শিখে গেলাম, এর একটা কারণ অবশ্য ছিলো, সেটা হলো বাজার থেকে টাকা মারা। কারণ ছবি দেখতে হবে তো! 


আমি যে বয়স থেকে ছবি দেখি সে বয়সে আমি কখনই টিকিট কাউন্টারের লোককে দেখতে পাইনি। টিকিটের টাকা সহ কোন রকমে গোড়ালি উঁচু করে কাউন্টারের ফোকর পর্যন্ত হাতটা গেলেই হয়েছে। টিকিট হাতে চলে আসতো। 


আমি বরাবর সামনের সারির দর্শক ছিলাম। কারণ সপ্তাহে যদি দু-তিনটে ছবি দেখতে হয় তবে ইনকাম অনুযায়ীই তো খরচাটা হতে হবে। আর এই ছবি যে দেখতাম সেটা নিশ্চয়ই বাবা মাকে বলে নয়, তাঁদেরকে ফাঁকি দিয়েই। 


কিভাবে করতাম? একটা কায়দা বের করেছিলাম। যশোর পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য ছিলেন আমার বাবা, আর আমি ছিলাম ক্ষুদে সদস্য। আমাদের দুজনেরই কার্ড ছিলো। আমি দুপুরে খেয়ে, হাতে আগে নিয়ে আসা বইটি নিয়ে লাইব্ররীর কার্ডঢি নিয়ে লাইব্রেরীতে বই আনার নিমিত্তে বাসা থেকে বের হতাম। যখন ফিরতাম তখন থাকতো আর একটা বই।

 

মানে হলো সিনেমা তো দেখতামই পাশাপাশি গল্পের বইও পড়তাম। বাসা থেকে বাবা-মা মনে করতেন, আমি লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়তাম এবং আসার সময় নতুন একটা বই নিয়ে আসতাম। কথাটা আংশিক সত্য ছিলো বৈকি। বইটা লাইব্রেরী থেকে শুধু পাল্টাতে যতটুকু সময়, এর পরের সময়টুকু আমি সিনেমা হলে। কোন কোন সপ্তাহে নতুন কোন ছবি রিলিজ না পেলে একই ছবি আবার দেখতাম। অভ্যাসটাতো ঠিক রাখতে হবে নাকি? ততদিনে ছবি দেখা আমার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে।


তবে ছোটবেলাতে ফ্যান্টাসী ছবিগুলো দেখতেই বেশী ভালো লাগতো। যেমন 'বাহাদুর' দেখার পর ওয়াসিম হয়ে গেল আমার প্রিয় নায়ক। ঐ সময়ে প্রত্যেক নায়কেরই দর্শকপ্রিয়তা ছিলো।

তাই সময়ের সাথে আমার পছন্দের নায়কও পরিবর্তিত হতো। ধীরে ধীরে একসময় দেখা গেল রাজ্জাক, সোহেলরানা, ফারুক, আলমগীর, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল - এরা সবাই আমার প্রিয় নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। ছেলেবেলায় ইমোশনাল সিনগুলো দেখে কান্নাও করতাম। একসময়ে একসাথে চুরি করে সিনেমা দেখার কিছু বন্ধুও পেয়ে গেলাম। তার মধ্যে বাড়ীর কাছের এক বন্ধু ছিল আমার নিয়মিত সঙ্গী। এমনও হয়েছে 'তালাক' ছবি দেখে দুই বন্ধু গলা জড়িয়ে ধরেও কান্না করেছি।


তবে এই যে চুরি করে এতোদিন ছবি দেখেছি হাতে নাতে ধরা পড়িনি অনেক অনেক দিন। বলে রাখা ভালো আমরা সব সময় ম্যাটিনি শো'তে ছবি দেখতাম। কথায় বলে না চোরের দশ দিন তো গৃহস্থের একদিন। 


তখন এস এস সি পরীক্ষা চলছে, ইলেকটিভ ম্যথের আগে কয়েকদিনের গ্যাপ ছিলো, এই সুযোগে আমি আর আমরা ঐ বন্ধু চলে গেলাম সাইকেল চালিয়ে, ক্যান্টনমেন্ট গ্যারিসন সিনেমা হলে ভারতীয় ছবি 'অনুসন্ধান' দেখতে।

যেহেতু ক্যান্টনমেন্ট ছিলো বাসা থেকে প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার দূরে তাই আসতে আসতে রাত হয়ে যায়। প্রথমে পড়ে ঐ বন্ধুর বাড়ী, ওর বাড়ী পর্যন্ত যেতেই দেখি বন্ধুর মা, আমার প্রিয় খালাম্মা দাঁড়িয়ে আছেন। উনি আমাকে তখনও ভালোবাসতেন এখনো ভালোবাসেন। 


আমাকে বললেন, 'এই তুইই বল কোথায় গিয়েছিলি তোরা? সিনেমা দেখতে নিশ্চয়ই।' 


খালাম্মা ছিলেন দারুণ স্মার্ট আর আমি একটু সরল সোজা, খাড়ার উপর মিথ্যা বলতে পারি না। তাই স্বীকার করে ফেললাম। খালাম্মা আমাকে খুব একটা কিছু বললেন না বরং আমাদেরকে যে ধরে ফেলেছেন এতেই উনি বেশ খুশী হলেন। আর সত্য বলারও তো একটা বেনিফিট আছে নাকি?


এই ছবি দেখার নেশাটা পুরো ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা পর্যন্ত ব্যাপকভাবেই ছিল। এরপর ছবি দেখাতে ভাটা পড়তে লাগলো। শেষের দিকে সালমান শাহ ছিলো আমার প্রিয় নায়ক। সালমান শাহ এর মতো স্মার্ট নায়ক আমি আর একটিও পাইনি। আমি তার ফ্যান ছিলাম। উনি মারা যাবার সাথে সাথে আমার হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভ্যাসটা চলে যায়। ততদিনে আমি খুলনা বিআইটিতে দ্বিতীয় বর্ষে।

লেখক : স্বপন ধর 

বিনোদন বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর