ঢাকা, ১২ নভেম্বর বুধবার, ২০২৫ || ২৮ কার্তিক ১৪৩২
good-food
১৮

ইলন মাস্ক কি বাস্তবের ‘আয়রন ম্যান’?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৭:১৭ ১২ নভেম্বর ২০২৫  

টনি স্টার্ক যদি সত্যিই পৃথিবীতে থাকতেন, তিনি কি মানুষকে কোন বিপদ থেকে বাঁচানোর বিনিময়ে এক ট্রিলিয়ন ডলার উপার্জন করতে চাইতেন, নাকি শুধু গাড়ি বিক্রি করেই সেই অর্থ চলে আসত তার কাছে? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে ইলন মাস্ককে ঘিরে। টেসলার বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে তার জন্য অবিশ্বাস্য, চোখ কপালে তোলা—প্রায় বিজ্ঞান–কল্পকাহিনির মতো—এক ট্রিলিয়ন ডলারের পারিশ্রমিক। হ্যাঁ, এক ট্রিলিয়ন! বারোটি শূন্যসহ এমন একটি সংখ্যা, যা ক্যালকুলেটর সহও অনেক ক্ষেত্রে কল্পনা করা কঠিন।

প্রশ্ন হল—এটা কি উদ্ভাবনের বিজয়, নাকি পুঁজিবাদের কাছে নিয়ন্ত্রণ হারানোর একটি দৃষ্টান্ত?

বিগত এক দশক ধরে মাস্ককে সিলিকন ভ্যালির ‘আয়রন ম্যান’ হিসেবে দেখা হয়। তিনি রকেট বানান, ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রি করেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় কৌতুক করেন, আর এক টুইটেই বিশ্ববাজার এলোমেলা করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

টেসলার পরিচালনা পরিষদের বিশ্বাস—মাস্ক মানেই টেসলা। তাকে ছাড়া গোটা আইডিয়াটাই  ভেঙে পড়বে। তাই তাকে ধরে রাখতে এই অবিশ্বাস্য পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি!

প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারহোল্ডারদের ৭৫ শতাংশই এর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। সংখ্যার হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠানে তার সমর্থকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। আশ্চর্যের বিষয় যে, এই অর্থ কোনো কোনো রাষ্ট্রের বার্ষিক আয়ের চেয়েও বেশি!

তবে এই অর্থ এমনি এমনি হাতে আসবে এমন নয়। এটি পুরোপুরি ‘পারফরম্যান্স–ভিত্তিক’। এই অর্থ পেতে আগামী এক দশকে মাস্ককে যেতে হবে বেশ অনেকটা পথ, লক্ষ্য পূরণ করতে হবে—২০ মিলিয়ন টেসলা গাড়ি চালুর, এক মিলিয়ন স্বচালিত রোবো–ট্যাক্সি বিক্রির, আরও ট্রিলিয়নখানেক ডলারের মুনাফা অর্জন করা, আর কোম্পানির বাজারমূল্য ১ ট্রিলিয়ন থেকে প্রায় ৮.৫ ট্রিলিয়নে তোলা। 

লক্ষ্যগুলো এতই ইউটোপিয়ান যে, সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন। কিন্তু, মাস্ক তো কোন সাধারণ মানুষ নয়, অন্তত এখন পর্যন্ত তার অর্জন তাকে সাধারণের কাতার থেকে এগিয়ে রাখে অনেকটাই।

তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়—একজন মানুষ কি সত্যিই এক ট্রিলিয়ন ডলার ধারনে সক্ষম, বিশ্বব্যাবস্থা কি প্রস্তুত?

এ প্রশ্ন বুঝতে গেলে কিছু তাত্ত্বিক আলাপ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, কার্ল মার্কসের ‘ক্যাপিটাল’ বিষয়ক চিন্তার দিকে নজর দেয়া যাক। মার্কস বলেছিলেন, সম্পদের মূল উৎস শ্রম, অথচ পুঁজিবাদ সেই শ্রমের মূল্য ঠিকমত পরিশোধ করে না। উদ্বৃত্ত সম্পদ জমা হয় ধনীর হাতে— তার মতে এটি ‘সারপ্লাস ভ্যালু’। মাস্ক নিজে গাড়ি বানান না, কোড লেখেন না। কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গির মূল্য আকাশচুম্বী, আর যারা প্রকৃত শ্রম দেন—তারা সিস্টেমের চোখে বদলযোগ্য। 

এই আলাপ অবশ্য ধ্রুব- এমন নয়, তবুও টিকে আছে কিন্তু ২০০ বছরেরও বেশই সময় ধরে।  

দ্বিতীয়ত, থরস্টেইন ভেবলেনের ‘কনস্পিকুয়াস কনসাম্পশন’ তত্ত্ব। 

ভেবলেন বলেছিলেন, ধনী শ্রেণি অর্থ খরচ করে শুধুই ক্ষমতার প্রদর্শন করতে—প্রয়োজন নয়। তার এই তত্ত্ব মতে, মাস্কের এই সম্ভাব্য ‘ট্রিলিয়ন’ আসলে প্রতীকী। এটা যেন এক মঞ্চনাটক—দুনিয়াকে বলা, “দেখো, একজন মানুষের দাম কত!” এর পেছনে বাস্তব যুক্তি থাকুক বা না-ই থাকুক। 

তৃতীয়ত, ম্যাক্স ওয়েবারের ‘প্রোটেস্ট্যান্ট এথিক।’ ওয়েবার ব্যাখ্যা করেছিলেন—আধুনিক পুঁজিবাদ নৈতিকতার মোড়কে ধনীদের সাফল্যকে দেবত্ব দিয়ে থাকে। মাস্ক সেই কাঠামোর নিখুঁত উদাহরণ। তিনি কারখানার মেঝেতে ঘুমান, দিন–রাত কাজ করেন, মানবজাতিকে রক্ষা করতে চান! ফলে তার সম্পদ আর লোভ হিসেবে দেখা যায় না—দেখা হয় এক মিশনের ফল হিসেবে।

অস্বস্তিকর সত্যটি হলো—এক ট্রিলিয়ন ডলারকে শুধুই ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে দেখা যাবে না; এটি কাঠামোগত ক্ষমতার এক ভিন্ন রূপ। এই অর্থ দিয়ে প্রভাব কেনা যায়, শিল্প বদলে দেওয়া যায়, সরকার পর্যন্ত নাড়িয়ে দেওয়া যায়। এই অর্থে অন্তত চার যুগ নাসার বাজেট জোগাড় করা সম্ভব। বিশ্বের বড় খেলাধুলার দল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সবই মালিকানায় আনা সম্ভব। প্রযুক্তির দিকনির্দেশ পর্যন্ত বদলে ফেলা সম্ভব। অর্থাৎ, এই অর্থ দিয়ে কেনা যায় ভবিষ্যৎ।

এই অর্থে কি কি সম্ভব, ভেবে না বের করা গেলেও, এই অর্থ উপার্জনের পথ কিন্তু এখনও অতটা মসৃণ নয় ভদ্রলোকের জন্য, বৈশ্বিক বাজার কিন্তু তাই বলছে। 

তাই প্রশ্ন হলো, টেসলা কি নিরাপদ? ইভি বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, নিয়ন্ত্রণ কঠোর হচ্ছে, আর্থিক চাপ বাড়ছে। একজন মানুষের ওপর এত বড় বাজি—যতই তিনি মেধাবী হন তা ঝুঁকিপূর্ণ। যেন আয়রন ম্যানকে গোটা পৃথিবীর সিইও বানানো, আর ধরে নেওয়া—তিনি কখনো ভুল করবেন না।

সমর্থকেরা অবশ্য বলেন—এই ভবিষ্যৎ বরাদ্দ বেশ যুক্তিসঙ্গত। মাস্ক ইলেকট্রিক গাড়িকে মূলধারায় এনেছেন, নিজে ফিরে আসতে পারে-  এরকম রকেট বানিয়েছেন, রোবট–প্রযুক্তিকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন। তাদের মতে—যদি কারও এক ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক হবার সম্ভাবনা বা যোগ্যতা থাকে, তবে সে মাস্ক।

সমালোচকেরা দেখেন অন্য ছবি। তারা বলেন—এ ব্যবস্থা বেশ ভঙ্গুর; যেখানে ব্যক্তিকে দেবতা বানানো হয়, প্রতিষ্ঠানকে নয়। একজন মানুষের হাতে এত ক্ষমতা থাকা বিপজ্জনক। কারণ, এত অর্থ শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য এমনটা নয়—জনগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব মূল বিবেচ্য তাদের কাছে।

মাস্কের ভাবমূর্তি অনেকটা মার্ভেল কমিকের ‘আয়রন ম্যান’ টনি স্টার্কের মতো—মেধাবী, দুষ্টুমি–প্রিয়, আকর্ষণীয়, ত্রুটিপূর্ণ। তাই প্রশ্ন—মাস্ক কি সুপারহিরোর কাল্পনিক জগতের বাস্তব প্রতিবিম্ব, নাকি পুঁজিবাদের সেই প্রতীক, যা আর বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইছে না? হয়তো দুটোই।

 

এক ট্রিলিয়নের গল্প শুধুই অর্থের গল্প নয়—বিশ্বাসের গল্পও। এটি দেখায় বাজারগুলো এখন আর প্রতিষ্ঠানকে নয়, ব্যক্তিতে বিশ্বাস্যই, বাজার এখন খুঁজে কে ভাল গল্প বানাতে বা বলতে পারে, সত্যিকারের নায়কেরা এখন আর বাজারের অংশ নয়। বাজার মনে করে—একজন মানুষ প্রযুক্তি, শিল্প, কল্পনা—সব এক হাতে  ধারণ করতে পারেন।

কিন্তু এই গল্প আরেকটা বিষয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়—বিশ্ব কত অসম হয়ে গেছে।

মার্কস বেঁচে থাকলে হয়ত বলতেন—এটাই হয়, যখন পুঁজি বিবেচনার চেয়েও দ্রুত বাড়ে। ভেবলেন বলতেন—এটা আসলে মর্যাদার প্রদর্শন। ওয়েবার মনে করিয়ে দিতেন—পুঁজিবাদ সবসময়ই নিজের সাফল্যকে নৈতিকতা দিয়ে ঢাকে।

শেষ প্রশ্নটা তাই থেকেই যায়—আমরা কি প্রতিভাকে উদযাপন করছি, নাকি তার কাছে আত্মসমর্পণ করছি?

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর