ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৪৩২৩

চিকিৎসাহীনতায় অযত্মে মারা গেলেন আনোয়ার : করোনা না হলেও দেয়নি লাশ!

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:৩৮ ৪ এপ্রিল ২০২০  

মো. আনারুল হক আনোয়ার। গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সতের রশিয়া। থাকতেন রাজধানীর শ্যামলীতে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল কোয়ার্টারে। স্ত্রী ছিলেন সিনিয়র স্টাফ নার্স। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে মারা যান মাস তিনেক আগে। 


ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতি-ঢাকা’র যুগ্ম সাধারন সম্পাদক এবং বৃহত্তর রাজশাহী জেলা সমিতি-ঢাকা’র যুগ্ম সম্পাদক, সদা হাস্যোজ্জ্বল আনোয়ার ছিলেন দারূন পরোপকারী। সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন কৃতী এ যুবক ছিলেন বিপদে পড়া মানুষের দু:খের সাথী। 


আর সেই আনোয়ারকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো অত্যন্ত নিভৃতে। প্রায় বিনা চিকিৎসায়,  অনেকটা অবহেলা-অযত্মে! 


দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিভিন্ন পরতে পরতে যে অনিয়ম-অযত্ম-অবহেলা এবং দায়িত্বহীনতা রয়েছে, তার ফের প্রমাণ মিললো সমাজকর্মী আনোয়ারের বেলায়।


অনাদর-অবহেলায় মৃত্যুর পর মরদেহটিও দেয়া হয়নি স্বজনদের কাছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একগঁুয়েমি করে পাত্তাই দেয়নি স্বজনদের। বরং হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের এন্তার অভিযোগ স্বজনদের।


স্বজনদের অভিযোগ, আনোয়ারকে  ‘জোর করে’ দাফন করা হয়েছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত সন্দেহে। অথচ, সরকারের পক্ষ থেকে বরারবরই বলা হচ্ছে, কোভিন-১৯ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগিদের দরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তারপরই নেয়া হচ্ছে নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা। 


আনারুল হক আনোয়ার অসুস্থ হয়ে বাসায় পড়ে গিয়েছিলেন। পরে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১ এপ্রিল। মানসিক-শারীরিক দুর্বলতা এবং জ্বরের পাশাপাশি তার স্ট্রোক হয়েছিল বলেও পরিবারের সদস্যরা ধারনা করছেন। 


তার ছোট ভাই মো: মাসুদ হক অভিযোগ করেছেন, মৃত্যুর পর ৩ দিন পার হলেও এখনও মৃত্যু সনদ দেওয়া হয়নি। 


এদিকে আনোয়ারের করোনাভাইরাস পরীক্ষার যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেখানে আরেকজনের নাম রয়েছে। তার বয়সও ভিন্ন।


ঢাকা শিশু হাসপাতালের গবেষণাগারে পরীক্ষার পর তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ ধরা পড়েনি।


পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আনোয়ারের ঘনিষ্ট নাজমুল হক মানিক লাইফটিভি’কে জানান, হাসপাতালে ভর্তি প্রক্রিয়ার পুরো সময় তিনি সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তী সময়কালেও হাসপাতালে ছিলেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালে আনোয়ারের কোনো চিকিৎসাই দেয়া হয়নি। ডাক্তাররাও কাছে ঘেঁষেননি। বলা যায় বিনা চিকিৎসাতেই পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে গেলেন তিনি।  


এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। সমস্যা সমাধানেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।


স্বজনরা জানান, আনোয়ারের স্ত্রী জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান-নিটোরের সিনিয়র স্টাফ নার্স ছিলেন। মাস তিনেক আগে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর হাসপাতালের ডরমিটরিতে থাকতেন তিনি। স্ত্রীর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণসহ প্রাতিষ্ঠানিক কিছু বিষয় নিষ্পত্তির জন্য থেকে গিয়েছিলেন আনোয়ার।

 

তার ছোট ভাই মাসুদ হক লাইফটিভি’কে বলেন, তার ভাই এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অসুস্থ ছিলেন।

 

গেল বুধবার ডরমিটরির তিনতলার ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মাথা ঘুরে পড়ে যান আনোয়ার। সম্ভবত স্ট্রোক করেছিলেন তিনি। প্রথমে নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল পরে সেখান থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।

 

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ সন্দেহে তাকে সোহরাওয়ার্দীর আইসোলেশন ইউনিটে রাখা হয়েছিল। বুধবার মধ্যরাতে অনাদরে-অবহেলায় সেখানেই মারা যান আনোয়ার।

 

আনোয়ারের ঘনিষ্ট আত্মীয় আবুল কালাম আজাদ লাইফটিভি’কে পুরো ঘটনা তুলে ধরে বলেন, ১ এপ্রিল সকালে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে স্ট্রোকের কথা ভেবে প্রথমেই পাশের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে তাকে কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি। চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও দেননি। পরে নেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তাররা কাছেই ঘেঁষেননি। চিকিৎসা দেননি। অনুরোধ জানাতে গেলে উল্টো তিরস্কার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আমরা মরবো নাকি!


আনোয়ারের ছোটভাই মাসুদ হক বলেন, বুধবার রাতে তার ভাইয়ের মুখ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। শিশু হাসপাতাল থেকে একটি টিম এসে নমুনা নিয়ে যায়। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কোনো ডাক্তার কিংবা নার্স চিকিৎসা দিতে আসেনি। বুধবার সন্ধ্যার পর একজন নার্স এসে বলেছিল ২ টি ট্যাবলেট খাওয়াতে। কিন্তু ট্যাবলেট খাবার মতো অবস্থা ছিল না রোগীর। নার্সকে বলেছিলাম, স্যালাইন কিংবা তরল ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে। ডাক্তারদের কাছেও অনেক অনুরোধ করেছি। কেউ এগিয়ে আসেনি চিকিৎসা দিতে।

 

এভাবেই বিনা চিকিৎসায় রাত ১২ টার দিকে আমার হাতের ওপরই মারা যান ভাই। ওই মুহূর্তেও ডাক্তার-নার্স ডেকে পাইনি। তারা বলে, কাছে এসে মরবো নাকি!


অনেক ডাকাডাকির পর প্রায় ১০ মিনিট পর একজন ডাক্তার এসে বলে যান, রোগী মারা গেছেন।  


কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাসুদ বলেন, মারা যাবার পর একটা চাদর চেয়েছিলাম লাশ ঢাকার জন্য। সেটাও দেয়া হয়নি।  


তিনি বলেন, রাতে মরদেহ বুঝিয়ে দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আমি একা অসহায় অবস্থায় ছিলাম হাসপাতালে। পরদিন  বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তাকে জানানো হয়, মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে না। খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে দাফনের জন্য দিয়ে দেওয়া হবে। এজন্য কিছু কাগজপত্রে তার সই চান কর্তব্যরত চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা।


‘কিন্তু সই দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। কাগজগুলো ছুঁইড়া ফেলে দেয়। বলে, তুই সই দিলেও লাশ নিয়ে যাব, না দিলেও লাশ নিয়ে যাব। দরকার হলে র‌্যাব-আর্মি ডাকবো। ওইখানে তো আমার কেউ নাই। বাধ্য হয়ে সই দিয়েছি। তারা আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।’-  বলেন মাসুদ হক। 


মাসুদ অভিযোগ করেন, কবরস্থান পর্যন্ত যেতে চাইলেও তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি।


“আমি বললাম - লাশ তো দিলেন না, অন্তত গোরস্তানে যেতে দেন। তারা বলল নেওয়া যাবে না, আমার পোশাক নাই। গাড়িতে আমাকে দিয়া লাশ তোলাইল। বলল জানাজা করতে নিয়া যাব। কিন্তু নিয়া গেল না। বললাম, ভাইয়ের দাফনের সময় পাশে থাকি। কিন্তু তারা আমাকে সেই গাড়িতে নেয়নি। বলে অন্য গাড়িতে আসতে। কিন্তু অনেকক্ষণ পর একটা গাড়ি পাইয়া ফোন দিছি। বলে দাফন করা হয়ে গেছে। এই দুঃখ সারাজীবন ভুলতে পারব না।”

 

‘জোর করে সই নেওয়া’ওই চিকিৎসক বা কর্মকর্তা কারও নাম বলতে পারেননি মাসুদ। তবে তাদের সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছিলেন বলে জানান তিনি।

 

মাসুদ অভিযোগ করেন, মৃত্যুর ৩ দিন পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনও তার ভাইয়ের মৃত্যুসনদ বুঝে পাননি। নভেল করোনাভাইরাস সন্দেহে যে পরীক্ষা করা হয়েছে, সেই পরীক্ষার রিপোর্টেও নাম ভুল।

 

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তির কাগজপত্রে আনোয়ারের বয়স লেখা হয়েছে ৫৫ বছর। তার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে ১ এপ্রিল ১৯৬৮। সে হিসেবে তার বয়স হয় ৫২ বছর।

 

তবে শিশু হাসপাতালের চাইল্ড হেলথ রিসার্চ হেলথ ফাউন্ডেশন থেকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেখানে তার নাম লেখা হয়েছে আশিক। বয়স লেখা হয়েছে ৭০ বছর।


মাসুদ বলেন, “লাশ দেয়নি, দেয়নি মৃত্যুসনদ, পরীক্ষার প্রতিবেদনেও নাম-বয়স ভুল। আমি এখন বাড়ি যাব কীভাবে? আমাকে কেন ছাড়ছেন আমাকেও হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠান। এলাকার মানুষ বলাবলি করছে যদি করোনাভাইরাস না-ই হয় তাহলে ঢাকায় দাফন করল কেন?”


অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, কাগজপত্রে জোর করে সই নেওয়া বা দুর্ব্যবহার করার বিষয়টি তার জানা নেই। প্রতিবেদনে নাম-বয়স ভুল আসার বিষয়টিও খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

 

তিনি বলেন, আমি বিষয়টি দেখব। ডেথ সার্টিফিকেট যদি না পেয়ে থাকে আমি বিষয়টি জানিয়ে রাখব। স্বজনদের মৃত্যুসনদ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। দুর্ব্যবহার করা, জোর করে স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।


আর প্রতিবেদনে নাম-বয়স ভুল আসার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, নাম নিয়ে বিভ্রান্তি হয়েছে সেটাও দেখা হবে। কেন এটা এমন হল তা দেখার বিষয় আছে। এইটা যদি তার রিপোর্ট না হয়ে থাকে, তাহলে তো আরেক ঝামেলা হবে।


এ ঘটনা নিয়ে মৃতের পরিবার- স্বজন-পরিচিত মহল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। বিষয়টি সম্পর্কে অনলাইন লাইভ ব্রিফিংকালে প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, তারা খোঁজ নেবেন। 


কিন্তু করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরেও মরদেহ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে না দিয়ে আল মারকাজুলের মাধ্যমে খিলগাঁও তালতলায় দাফন কেন করা হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব দেননি মহাপরিচালক। 


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে সবাইকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশ দিচ্ছেন, করোনা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত নিবিড়ভাবে মনিটরিং করছেন, সবাইকে সহনশীল আচরন করে রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তখন এমন অযত্ম-অবহেলা-দায়িত্বহীনতা কেন … এমন প্রশ্ন করছেন পরিবারের সদস্য - আপনজন এবং পরিচিতজনরা।

 

করোনা নেগেটিভ হবার পরেও স্বজনদের কাছে লাশ বুঝিয়ে না দিয়ে, স্বজদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং জোর করে কেন দাফন করা হচ্ছে - এ প্রশ্নও শোকসন্তপ্ত স্বজনদের।