ঢাকা, ১০ নভেম্বর সোমবার, ২০২৫ || ২৬ কার্তিক ১৪৩২
good-food

ডলারের সিংহাসন কি নড়বড়ে?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৬:৩৬ ১০ নভেম্বর ২০২৫  

বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির রাজা মার্কিন ডলার। গত প্রায় ৮০ বছর ধরে এই মুদ্রা একাই শাসন করে চলেছে বিশ্ব বাণিজ্য আর রাজনীতির ময়দান। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, স্থিতিশীলতা আর আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই ডলার। কিন্তু সেই রাজার সিংহাসন কি এখন নড়বড়ে? খোদ আমেরিকার পাহাড়সমান ঋণ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং বিশ্বের বুকে নতুন অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থান সেই প্রশ্নকেই জোরালো করে তুলেছে। যে ডলার ছিল একসময় অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার প্রতীক, আজ তার ভবিষ্যৎ নিয়েই তৈরি হয়েছে গভীর সংশয়। এই সংশয় নিয়েই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পলেটিক্স টুডে। 

‘উচ্চ আদর্শ’ এর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে

একসময় ডলারের নোটের প্রতীক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন আর আদর্শের কথা বলত—একটি অগ্রগতিমুখী ও সম্ভাবনাময় স্বপ্ন দেখাতো। কিন্তু গত দেড় দশকে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি এবং আত্মকেন্দ্রিক আচরণ সেই আদর্শকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য আর অবিচারের অনুভূতি বেড়েছে।

এই আস্থাহীনতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরীণ সংকট। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে মার্কিন ফেডারেল সরকারের ‘শাটডাউন’ বা অচলাবস্থার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটি শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়, বরং একটি স্বীকারোক্তিও বটে। ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া ফেডারেল ঋণ এখন আমেরিকার জন্য এক নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য বোঝায় পরিণত হয়েছে।

এই পরিস্থিতি মার্কিন বন্ডের প্রতি বিশ্বের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ১৯৯৬ সালের পর এই প্রথম বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে ডলারের চেয়ে স্বর্ণের পরিমাণ বেড়ে গেছে, যা এক বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের টিকে থাকার লড়াই

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় অর্ধেকই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। এই অর্থনৈতিক আধিপত্যকে স্থায়ী রূপ দিতে ১৯৪৪ সালে ‘ব্রেটন উডস’ চুক্তির মাধ্যমে ডলারকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বর্ণের সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় এটি হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ মুদ্রা। পরের ৮০ বছর বিশ্ব অর্থনীতি চলেছে ডলারের ইশারায়। ইউরোপের পুনর্গঠন থেকে শুরু করে জ্বালানি তেলের বাণিজ্য—সবকিছুই ছিল ডলারনির্ভর।

কিন্তু ৮০ বছর পর আজ সেই স্তম্ভগুলো নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। আমেরিকার আকাশছোঁয়া ঋণ, সুদের বোঝা এবং লাগামছাড়া সম্প্রসারণমূলক অর্থনীতি ডলারের ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ পরিচয়কে ফিকে করে দিয়েছে। অন্যদিকে, ব্রিকস এর মতো জোট এবং গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো ডলারের বাইরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য করার পথ খুঁজছে। ডলারের সাম্রাজ্য আজ তাই অস্তমিত হওয়ার পথে।

সুদের হার, ঋণ ও ফেডের দ্বন্দ্ব

৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ এখন শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য এক সতর্ক ঘণ্টা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংক উভয় দেখিয়ে দিয়েছে যে, এই বিপুল পরিমাণ ঋণ বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, ২০২৫ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু ঋণের সুদ বাবদই গুনতে হবে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেটের চেয়েও বেশি।

এই সংকট এখন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও উত্তপ্ত করে তুলেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) উচ্চ সুদের হার নীতিকে ‘অর্থনীতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই রাজনৈতিক বিভাজন ডলারের স্থিতিশীলতার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।

বৈশ্বিক অঙ্গনে ডলারের মর্যাদা ক্ষয়

একসময় বিশ্বের ৮০ শতাংশ বাণিজ্য এবং ৭০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ডলারে রাখা হতো। কিন্তু ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর সেই চিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। গত ১০ বছরে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে ডলারের অংশ কমে ৫৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, স্বর্ণের মজুত বাড়ছে।

এর অন্যতম কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে রাশিয়া, চীন ও ইরানের মতো দেশগুলো ডলারের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে বিকল্প পথের সন্ধান করছে। জেপি মরগ্যানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের বিনিয়োগে ডলারের পরিমাণ কমিয়ে চীনা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি এবং অন্যান্য স্থানীয় মুদ্রার ওপর জোর দিচ্ছে।

ঋণের বোঝা ডলারের পতন ত্বরান্বিত করছে

বিপুল ঋণের কারণে মার্কিন সরকারি বন্ড এখন আর আগের মতো ‘ঝুঁকিমুক্ত’ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। চীন, রাশিয়া, ভারত ও তুরস্কের মতো দেশগুলো তাদের রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ কমিয়ে স্বর্ণ এবং অন্যান্য সম্পদের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ফিচ এবং মুডিসের মতো খ্যাতনামা ক্রেডিট রেটিং সংস্থাও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি মার্কিন বন্ড কেনা কমিয়ে দেয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে ডলারের চাহিদা কমে যাবে, যা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ঐতিহাসিক বিপর্যয়।

বিকল্প অনুসন্ধান: ব্রিকস ও বহুমুদ্রাভিত্তিক যুগ

ডলারের একাধিপত্যের বিপরীতে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো এখন একজোট হচ্ছে। রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে ব্রিকস জোট ডলারবিহীন লেনদেনের জন্য ‘ব্রিকস পে’ নামে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা তৈরির কাজ করছে। সম্প্রতি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরের মতো জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো ব্রিকসে যোগ দেওয়ায় এই প্রক্রিয়া আরও গতি পেয়েছে। যদি তেলের বাণিজ্য ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রায় শুরু হয়, তাহলে ১৯৭০-এর দশক থেকে চলে আসা ‘পেট্রোডলার’ ব্যবস্থার পতন ঘটবে।

বিশ্ব অর্থনীতি এখন এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে একটি বহুমুদ্রাভিত্তিক নতুন যুগে প্রবেশ করছে। আমেরিকার ঋণ সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করছে। ডলার হয়তো রাতারাতি শীর্ষস্থান হারাবে না, কিন্তু একক আধিপত্যের দিন যে শেষ হয়ে আসছে, তা স্পষ্ট।

আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতো সংস্থাগুলোও বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব একটি বহুমুদ্রাভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করবে। ডলারের সিংহাসন কাঁপছে, আর বিশ্ব অর্থনীতির এক নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে—যেখানে কোনো একক রাজার শাসন নয়, বরং বহু শক্তির অংশগ্রহণ থাকবে।