ঢাকা, ১৭ নভেম্বর সোমবার, ২০২৫ || ২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২
good-food
১২

নিউ ইয়র্কের মেয়র তো হলেন, এরপর কী করবেন মামদানি?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৯:৪৭ ১৬ নভেম্বর ২০২৫  

এক বছর আগেও কুইন্সের বাইরে খুব কম মানুষই জোহরান মামদানির নাম জানতেন। আজ তিনি নিউ ইয়র্ক শহরের নতুন মেয়র। মার্কিন ইতিহাসে তিনি শতাব্দীর সবথেকে তরুণ, একই সঙ্গে শহরটির ইতিহাসের প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও প্রথম মুসলিম মেয়র। এ অর্জনগুলো নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মাইলফলক। তবে এখন প্রশ্নগুলো তার জয়ী হবার প্রক্রিয়া থেকে অনেকটুকুই সরে এসেছে। সবখানেই এখন আলোচনার বিষয় তিনি এরপর কী করবেন।

মামদানির এই জয় বেশ চমকপ্রদ। প্রচারণার শুরুতে তার সমর্থন ছিল মাত্র এক শতাংশ। কিন্তু গ্রীষ্মের আগেই তিনি পরাজিত করেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবীদদের, বড় বড় করপোরেট তহবিলের আক্রমণ সামলে নেন সাধারণ মানুষের মন জয় করে, আর শহরের পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন এক গণভিত্তিক প্রচারযাত্রা। তার বার্তা ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্ট যে, “নিউ ইয়র্ককে আবার সাশ্রয়ী করো।” বাড়িভাড়া, যাতায়াতভাড়া ও শিশুযত্নের ব্যয়ে জর্জরিত লাখো নিউইয়র্কবাসীর মনে সেটি দাগ কেটেছিল গভীরভাবে।

তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কঠিন কাজ রয়ে গিয়েছে সামনের দিনগুলোর জন্যই। নির্দিষ্ট সীমার পর বাড়িভাড়া স্থগিত, বিনামূল্যে ২০২৭ থেকে গনপরিবহন ও শিশু যত্ন চালু, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো এবং ধনীদের উপর কর বৃদ্ধি—মামদানির এসব প্রতিশ্রুতি নিউ ইয়র্কবাসীর জীবনযাত্রার খরচ কমানোর লক্ষ্য হলেও বাস্তবে তা বেশ ব্যয়বহুল। তার আবাসন পরিকল্পনাই প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের, যার মধ্যে ৭০ বিলিয়নই ধার করতে হবে সুদ পরিশোধের শর্তে, আর তা শোধ হবে কর বৃদ্ধি করে। মামদানি বলছেন, ধনকুবের ও বড় করপোরেশনগুলোর ওপর কর বাড়িয়ে তিনি অর্থ জোগাবেন। কিন্তু তার জন্য দরকার রাজ্য আইনসভা ও গভর্নরের অনুমোদন। আর গভর্নর ক্যাথি হোকুল, ডেমোক্র্যাট হলেও, ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে, এই মুহূর্তে তিনি কর বাড়াতে রাজি নন।

অর্থাৎ, মামদানিকে প্রচারণার কবিতা ছেড়ে বাস্তব শাসনের গদ্য রচনা করতে হবে। তিনি নিজেকে ‘সমঝোতার সেতুবন্ধনকারী’ হিসেবে তুলে ধরেছেন। আর এই দক্ষতাই নির্ধারণ করবে তার প্রথম বছর কেমন যাবে। অ্যালবানির সমর্থন না পেলে তার বড় পরিকল্পনাগুলো আটকে যেতে পারে। প্রশ্নটা জনপ্রিয়তার নয়, কারণ তা তিনি পেয়েছেন। বরং তিনি অর্থ আর মিত্রতা জোগাড় করতে পারেন কি না, সেটিই আসল চ্যালেঞ্জ।

তবু মামদানিকে আলাদা করে তোলে কিছু বৈশিষ্ট্য। তাঁর আন্তরিক কথাবার্তাগুলো দ্রুত আর কখনো অসম্পূর্ণ হলেও তা সরল। জটিল নীতি বোঝাতে তিনি ব্যবহার করেন দৈনন্দিন জীবনের উদাহরণ। এক ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি হালাল খাবারের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ‘হালালফ্লেশন’-এর মজা করে বলছিলেন, ‘রাস্তার খাবারও এখন বিলাসিতা হয়ে গেছে’। এ ধরনের হাস্যরসই তরুণ ভোটারদের সঙ্গে তার সহজ সংযোগ গড়ে তুলেছে। তার সামাজিক মাধ্যমের প্রচারণাও ছিল প্রাণবন্ত।

এই বাস্তবধর্মী প্রাণবন্ত চরিত্রই হতে পারে তার সবচেয়ে বড় শক্তি। নিউ ইয়র্ক বহুবার দেখেছে বড় প্রোফাইলের নেতা, যাদের মানবিক সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। মামদানির ধারা ভিন্ন; কম শিরোনাম, বেশি কাজ করা। প্রচারণার সময় তিনি ম্যানহাটন হেঁটে বেড়িয়েছেন। কথা বলেছেন ফুটপাতের মানুষদের সাথে, দোকানে, সাবওয়ে স্টেশনে। শুনেছেন সবার কথা। নিউ ইয়র্কের সাধারণ মানুষের জন্য এই অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন।

অবশ্য সবাই তার পক্ষে নয়। সমালোচকেরা বলছেন, মামদানি অতিমাত্রায় বামঘেঁষা। রিয়েল এস্টেট আর ওয়াল স্ট্রিটের টাকায় গড়ে ওঠা নিউ ইয়র্ক শহরের ক্ষমতাধরদের জন্য এটি বেশ অস্বস্তির কারণ হতে পারে । কিন্তু তার জয় ইঙ্গিত দিচ্ছে, মানুষের বদলাচ্ছে। তরুণ ভোটার, বাড়িভাড়া দিয়ে টিকে থাকা লাগে এমন নাগরিক, প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী তারা এখন ‘সোশ্যালিস্ট’ বা ‘সেন্ট্রিস্ট’ ট্যাগে কম, শহরটাকে আবার বাসযোগ্য করে তুলতে পারবেন এমন নেতায় বেশি আগ্রহী। মামদানি তার প্রতিশ্রুতির অল্প অংশও যদি বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে বদলে যেতে পারে শুধু নিউইয়র্ক নয়, ডেমোক্র্যাট দলের জাতীয় কৌশলও।

নীতির বাইরেও, তার উত্থানেরও এক ধরনের প্রতীকী অর্থ রয়েছে। মামদানির পরিবার তাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল উগান্ডায়। মা চলচ্চিত্র নির্মাতা, বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এমন এক শহরে তিনি বেড়ে উঠেছেন, যা সব সময় অভিবাসীদের প্রতি সদয় ছিল না। তাই শহরের অভিবাসী পরিবারগুলোর কাছে তার গল্প এক অনুপ্রেরণা।

তবে শুধু অনুপ্রেরণা দিয়ে ভাড়া মেটানো যায় না। জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার পর মামদানি পাবেন এক শহর, যা এখনো অর্থনৈতিক চাপ, আবাসন সংকট ও গণপরিবহন কাটছাঁট থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়নি। তার সাফল্য নির্ভর করবে তিনি তার আদর্শকে কতটুকু বাজেটে আর স্লোগানকে আইনে রূপ দিতে পারেন তার ওপর। যা টিকটক প্রচারণার ঝলমলে সময় থেকে বেরিয়ে, নেতৃত্বের আরেক প্রকৃত পরীক্ষা তার জন্য অপেক্ষা করছে।

এই পরীক্ষার ফল শুধু সিটি হলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। যদি মামদানি আদর্শ আর বাস্তবতার ভারসাম্য রাখতে পারেন—যদি তিনি নিউ ইয়র্ককে একই সঙ্গে ন্যায্য ও কার্যকর করতে পারেন—তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নগর নেতৃত্বের নতুন মানদণ্ড তৈরি করতে পারবেন। ব্যর্থ হলে সমালোচকেরা বলবেন, বড় প্রতিশ্রুতি ক্ষমতার বাস্তবতার সঙ্গে টিকে না।

এখন শহর তাকিয়ে আছে মিশ্র অনুভূতিতে—আশা ও সংশয়ে। এক ৩৪ বছর বয়সী অভিবাসী তরুণ রাজনৈতিক রাজবংশকে হারিয়ে ইতিহাস লিখেছেন। এই গল্পের পরিসমাপ্তি হবে বাস্তব পরিবর্তনে, না কি নিউ ইয়র্কের ‘প্রায়ই তো হচ্ছিল’ তালিকার আরেক অধ্যায়ে—তা নির্ভর করবে তার পরের পদক্ষেপে। কেননা প্রচারণা ছিল শিরোনাম; আসল পরীক্ষা এখন শুরু।

নিউইয়র্কের সীমানা ছাড়িয়ে মামদানির জয়ের প্রতিধ্বনি

জোহরান মামদানির এই জয় কেবল নিউ ইয়র্কের বাড়িভাড়া বা পরিবহন ইস্যুর গল্প নয়, এর প্রতিধ্বনি পৌঁছেছে শহরের বাইরে, এমনকি কূটনৈতিক বলয়েও। গাজার ঘটনায় ইসরায়েলের সমালোচনা করে প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। আমেরিকার সবচেয়ে আন্তর্জাতিক শহরের কণ্ঠে এক নতুন সুর যোগ করেছে তার এই অবস্থান।

নিউ ইয়র্ক শুধু সংস্কৃতির নয়, কূটনীতিরও অন্যতম কেন্দ্র—এখানেই জাতিসংঘের সদর দপ্তর, এখান থেকে প্রায়ই বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি কোথায় যাচ্ছে। তাই মামদানির ন্যায় ও জবাবদিহিতার ওপর জোর শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, বৈশ্বিক রাজনীতিতেও এক প্রজন্মান্তরের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। তরুণ নেতারা এখন আগের চেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ পুরোনো জোটকে প্রশ্ন করতে, মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলতে—যে পক্ষই ক্ষমতায় থাকুক না কেন।

তবু মামদানির পথ সহজ নয়। মেয়র জাতীয় নীতি ঠিক করেন না, কিন্তু তার প্রতিটি বক্তব্য বিশ্লেষণ করা হয় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখেই। তিনি যদি নৈতিক অবস্থান বজায় রেখে কূটনৈতিক সংবেদনশীলতা সামলাতে পারেন, তবে তার নেতৃত্ব হতে পারে এক নতুন আমেরিকান ধারার সূচনা—যেখানে সত্য বলা হবে খোলামেলাভাবে, যদিও তা শুনতে কারও কারও অস্বস্তি লাগতে পারে।